দিনশেষে বিজয়ী মুশফিক-লিটন
ক্রিকেট এমনই। তিন কাঠির খেলার প্র্রতিটি বাকেই লুকিয়ে রয়েছে রহস্য আর রোমাঞ্চ। কখনো এসে ধরা দেয়। কখনো আড়ালেই থেকে যায়। যখন ধরা দেয় বা দেখা দেয় সব ধরনের উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ ছড়িয়ে হাজির হয়। এবার যেমন এসে হাজির হয়েছিল বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কার ঢাকা টেস্টে। টস জিতে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৬.৫ ওভারেই ২৪ রানে নেই বাংলাদেশের পাঁচ উইকেট। তখনো খেলার আধ ঘণ্টা যায়নি। লঙ্কান দুই পেসার কাসুন রাজিথা ও আশিথা ফার্নান্ডোর বলে গতি আর সুইংয়ের সংমিশ্রনে খেলা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তাতে করে লাঞ্চের আগে বাংলাদেশ অলআউট হওয়ার ভাবনা কেউ করে থাকলে খুব একটা ভুল করেননি। কিন্তু বাংলাদেশ অলআউট হয়নি।
এমন কি দিনের বাকি সময় আর কোনো উইকেটও পড়তে দেয়নি। ম্যাচের পরিস্থিতিতে একটি বিশ্ব রেকর্ডের সঙ্গে কয়েকটি কীর্তি গড়ে এ রকম অসাধ্যনের কাজটি করেন অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম ও টেস্ট ক্রিকেটে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা লিটন দাস। মুশফিক টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করে ১১৫ ও লিটন দাস ক্যারিয়ারের সেরা ব্যাটিং করে ১৩৫ রানে অপরাজিত। আর বাংলাদেশের সংগ্রহ সেই পাঁচ উইকেটে ২৭৭। লিটন-মুশফিক জুটির অবদান ২৫৩। এই রান ২৪ রানে পাঁচ উইকেট হারানোর পর ষষ্ট উইকেট জুটিতে বিশ্ব রেকর্ড। আগের সর্বোচ্চ রান ছিল ৮৬।
১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের ওয়ালিস ও সুজাউদ্দিন এই রান করেছিলেন। ভেন্যু ছিল ঢাকা (আজকের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) স্টেডিয়াম। আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ষষ্ট উইকেট জুটিতে সর্বোচ্চ। আগের সর্বোচ্চ রান ছিল ১৯১। এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ২০০৭ সালে কলম্বোতে করেছিলেন। সেখানেও ছিলেন মুশফিক। অপরজন ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। আবার এই দুই জনে অস্টম জুটি হিসেবে হাজার রান করেছেন । এভাবেই দুই জনের ব্যাটিং দ্যুতিতে সকালে যে কাল বৈশাখির ঝড়ের আভাস ছিল বাংলাদেশের ইনিংসে, তা কেটে গিয়ে শেষ বিকালেও সূর্যের উজ্জ্বল কিরণে আলোকিত ছিল বাংলাদেশ দলের আকাশ। প্রথম সেশনে যেখানে ২৩ ওভারে রান উঠে ছিল পাঁচ উইকেটে ৬৬, সেখানে পরের দুই সেশনে রান উঠে ৩০ ওভারে ৮৭ ও ৩২ ওভারে ১২৪।
মুশফিক-লিটন জুটির কল্যাণে দিনটি বাংলাদেশময় হয়ে উঠা প্রথম দিনের চিত্রনাট্যকে তাই অনায়েসে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ৬.৫ ওভারে ২৪ রানে পাঁচ উইকেট, অপরটি দিনের বাকি সময়। যারা টসের শুরু থেকে খেলার দিকে নজর রাখেননি, তারা যদি হঠাৎ করে স্কোর কার্ড দেখে থাকেন, তাহলে দেখেই অধিনায়ক মুমিনুলের চৌদ্ধগোষ্ঠী উদ্ধার করবেন? কেন টস জিতে ব্যাটিং বেছে নিলেন। কিন্তু মুমিনুল কোনো ভুল করেননি। পিচে সামান্য ঘাস ছিল। প্রথম ঘণ্টা ব্যাটসম্যানদের সহায়তা করবে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটসম্যানদের জন্য খেলা কঠিন হয়ে পড়বে। একই কথা বলেছিলেন লঙ্কান দলপিতও। আবার পিচ রিপোর্টে ধারাভাষ্যকার ছিলেন আরেকটু বেশি সরস। তিনি জানিয়েছিলেন শুরুর দিকে পেসাররা সহায়তা পেলেও পরের দিকে স্পিনারদের হয়ে কথা বলবে। মূলত এ্ই দৃষ্টিকোন থেকেঅই মুমিনুলের টস জিতে ব্যাটিং বেছে নেওয়া। তবে এভাবে উইকেট পতনের পেছনে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদেরও দায় আছে। ওপেনার মাহমুদুল হাসান জয় ও নাজমুল হোসেন শান্ত বোল্ড হলেও আউট হওয়া বাকি তিন ব্যাটসম্যান তামিম ইকবাল, মুমিনুল ও সাকিব নিজেদের দায় এগাতে পারবেন না।
ইনিংসের ও রাজিথার দ্বিতীয় বলেই মাহমুদুল হাসান জয় ক্যারিয়ারে চতুর্থবারের মতো শূন্য রানে আউট হওয়ার পর আশিতা ফার্নান্ডোর পরের ওভারে (ইনিংসের দ্বিতীয়) চতুর্থ বলে তামিম ইকবালও ক্যারিয়ারে দশমবারের মতো শূন্য রানে সাজঘরে মুখী হন পয়েন্টে জয়াভিক্রমার ডাইভিং ক্যাচে পরিণত হয়ে। তামিম ফ্লিক করতে গিয়ে লাইন মিস করে ফেলেন। বলটি এমন কোনো কঠিন ছিল না। এই আশিতা ফার্নান্ডোই আবার মুমিনুলের ব্যর্থতার পাল্লা ভারী করে নয় রানে উইকেটের পেছনে নিরোশান ডিকভেলার ক্যাচে পরিণত করেন। মুমিনুল খেলবেন কী খেলবেন না এই সিদ্ধান্তে দিধাগ্রস্ত হয়ে দেরি করে উইকেট দিয়ে আসেন। রাজিথা তার দ্বিতীয় শিকার করেন রাউন্ড দ্য উইকেটে নাজমুলকে আট রানে বোল্ড করে। পরের বলেই সাকিবকে শূন্য রানে এলবিডব্লির ফাঁদে ফেলে হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলেন। তার রাউন্ড দ্য উইকেটে বল ভেতরে ডুকার মুহূর্তে সাকিব লেগ সাইটে খেলতে গিয়ে ব্যাটে-বলে মিলন ঘটাতে পারেননি। বল গিয়ে আঘাত হানে প্যাডে। লঙ্কানদের আবেদনে একটু ভেবে আম্পায়ার সিন্ধান্ত দেন। সাকিব সঙ্গে সঙ্গেই রিভিউ নিয়েও বাাঁচতে পারেননি। ক্যারিয়ারের পঞ্চম আর প্রথম বলে দ্বিতীয়বার তিনি শূন্য রানে আউট হলেন। রাজিথাকে হ্যাটট্রিক বঞ্চিত করেন লিটন দাস। মুশফিকের সঙ্গে লিটন জুটি বাঁধার পর দুই ব্যাটসম্যান ধীরে ধীরে লঙ্কান বোলারদের উইকেট নেওয়ার উত্তেজনা প্রশমিত করতে থাকেন। দিন শেষে পরে যা নেমে আসে শূন্যের কোটায়।
চট্টগ্রাম টেস্টেই সেঞ্চুরি পেতে পারতেন লিটন দাস। আউট হয়েছিলেন ৮৮ রানে। লাঞ্চের পরপরই প্রথম বলে বিলাসী শর্ট খেলতে গিয়ে তিনি নিজের শনি ডেকে এনেছিলেন। কিন্তু ঢাকা টেস্টে আর তিনি সে ভুল করেননি। দলের চরম বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি সেঞ্চুরি পান অনেকটা শ্রীলঙ্কান ফিল্ডারদের উপহার হিসেবে। লিটনের সেঞ্চুরিক উপহার বলা হলো এ কারণে যে তার সেঞ্চুরিটি এসেছে লঙ্কান ফিল্ডারদের ওভার থ্রো থেকে চার রান আসলে। লিটন তখন ৯৭ রানে ব্যাট করছেন। পেসার আশিতা ফার্নান্ডোর বল লিটন স্কয়ার লেগে খেলে এক রান নিতে ছুটেন। কিন্তু রান আউট করার ইচ্ছে থেকে ধনাঞ্জায়া নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে বল থ্রো করেন। কিন্তু সেই বল পরে লং অফ দিয়ে সীমান পার হয়ে গেলে লিটন বোনাস হিসেবে চার রান পেলে তার সেঞ্চুরি হয়ে যায় ১৪৯ বলে ১৩ চারে। সেঞ্চুরি হওয়ার পরই লিটন হেলমেট খুলে ব্যাট উঁচিয়ে ধরেন।
সেঞ্চুরি যে কোনো ব্যাটসম্যানের জন্য আরাধ্য। কখনো কখনো কোনো কোনো সেঞ্চুরি আবার প্রতিবাদের ভাষাও হয়ে উঠে। চট্টগ্রাম টেস্টে মুশফিকুর রহিমের সেঞ্চুরি ছিল সেই রকমই প্রতিবাদের ভাষা। সেই সেঞ্চুরির আগে দলের সিনিয়র ক্রিকেটার হঠাও কর্মসূচির ডাক দিয়েছিলেন বিসিবির সভাপতি। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছিল শুধু মুশফিকুর রহিমের নাম। সেঞ্চুরি করে মুশফিক জানিয়ে দিয়েছিলেন পুরান চাল ভাতে বাড়ে। সেই মুশফিক এবার সেঞ্চুরি করেছেন ঢাকা টেস্টে। পিটাপিটি সেঞ্চুরি। প্রতিবাদের ভাষা থেকে প্রতিরোধের ভাষা। দুইটি সেঞ্চুরিকে দুইভাবে সংজ্ঞাযিত করা যায়। তবে চট্টগ্রামের সেঞ্চুরি করতে তিনি যে রকম সময় নিয়েছিলেন এবারের সেঞ্চুরিতে সে রকম সময় নেননি। চট্টগ্রামে ব্যাট করতে নেমেছিলেন দলের ভালো অবস্থানে। কিন্তু তার নিজের অবস্থান ভালো ছিল না। তাই তিনি ছিলেন বেশ সাবধানী। যে কারণে ক্যাািরয়ারের মন্থর সেঞ্চুরি করেন তিনি। বল খেলেছিলেন ২৭০টি। বাউন্ডারি ছিল মাত্র চারটি। এবার দলের ক্রান্তিকালে নেমে তিনি সেঞ্চুরি করেন ২১৮ বলে ১১ চারে। সময় নেন ৩১৪ মিনিট।
এমপি/এমএমএ/