শরণার্থী ইস্যুতে পশ্চিমাদের বর্ণবাদী অবস্থান
ইউক্রেন থেকে আসা শরণার্থীদের এক হাতে বাচ্চাদের আর অন্য হাতে জিনিসপত্র নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে দেখা যাচ্ছে। জাতিসংঘ বলছে, এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখের অধিক ইউক্রেনীয় শরণার্থী প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিবেশীরা এসব শরণার্থীকে উষ্ণ আতিথেয়তা দিয়ে বরণ করে প্রশংসিত হচ্ছে।
কিন্তু ইউক্রেনীয়দের প্রতি ইউরোপের এসব প্রতিবেশীর মনোভাব ইরাক-সিরিয়া থেকে আশ্রয় নেওয়া মুসলিম শরণার্থীদের ব্যথিত করেছে। কারণ ইউরোপের নেতারা বলছেন, ইউক্রেনীয়রা ইউরোপীয় এবং সুশিক্ষিত। কাজেই তারা শরণার্থী নয়। তারা আমাদের ভাই। ইউক্রেনীয়রা সিরিয়া-ইরাক থেকে আসা শরণার্থীদের মতো নয় যে তাদের আমরা শরণার্থী বলব।
ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, মলদোভা এবং রোমানিয়ার মতো দেশের নেতারা আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাচ্ছেন। কিন্তু ইউরোপের কিছু নেতার বক্তব্য মুসলিম শরণার্থীদের ব্যথিত করেছে।
উদাহরণস্বরূপ বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী কিরিল পেটকভের বক্তব্যের কথাই ধরা যাক। সম্প্রতি তিনি ইউক্রেনীয়দের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এরা আমাদেরই, শরণার্থী নয়...এরা ইউরোপীয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই লোকেরা বুদ্ধিমান, শিক্ষিত মানুষ। ...এটি এমন শরণার্থীর ঢেউ নয় যে যাতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম, আমরা তাদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না, অস্পষ্ট অতীতের লোকেরা, যারা এমনকি সন্ত্রাসীও হতে পারত...’
‘অন্য কথায়’, বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী যোগ করেছেন, ‘এখন এমন একটিও ইউরোপীয় দেশ নেই যা শরণার্থীদের বর্তমান ঢেউয়ে ভীত।’
সিরিয়ার সাংবাদিক ওকবা মোহাম্মদ বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে ‘বর্ণবাদ এবং ইসলামফোবিয়া’ বলে অভিহিত করেছেন।
২০১৮ সালে ওকবা মোহাম্মদ সিরিয়া থেকে পালিয়ে যান। তিনি এখন স্পেনে থাকছেন এবং অন্যান্য সিরীয় উদ্বাস্তুদের সঙ্গে আরবি এবং স্প্যানিশ ভাষায় প্রথম দ্বিভাষিক পত্রিকা পত্রিকা চালান। তিনি বলছেন যে তিনি পেটকভ এবং অন্যদের মন্তব্যে অবাক হননি।
মোহাম্মদ ইউক্রেনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের অনুভূতির বর্ণনা দিয়েছেন। হাজার হাজার ইউক্রেনীয়ের মতো, তাকেও রাশিয়ান বোমা থেকে রক্ষা করার জন্য ভূগর্ভে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। তিনি তার শহর থেকে পালানোর জন্য একটি উপচে পড়া বাসে উঠতেও লড়াই করেছিলেন। সীমান্তে পরিবার থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তিনি।
এ প্রসঙ্গে ওকবা মোহাম্মদ বলেন, ‘একজন শরণার্থী হল শরণার্থী, ইউরোপীয়, আফ্রিকান বা এশিয়ান যাই হোক না কেন।’
যখন ইউক্রেনের কথা আসে, ইউরোপের কিছু চরম অভিবাসনবিরোধী নেতাদের সুরের পরিবর্তন লক্ষণীয়, ‘আমরা কাউকে প্রবেশ করতে দেব না; থেকে ‘আমরা সবাইকে প্রবেশ করতে দিচ্ছি।’
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে এই মন্তব্য করেছেন। প্রথমদিকে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিনি মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে হাঙ্গেরির মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশ করতে চাওয়া মানুষদের ‘অভিবাসী এবং শরণার্থী’ হিসেবে সম্বোধন করছিলেন। দ্বিতীয়টিতে, এই সপ্তাহে, তিনি ইউক্রেন থেকে আসার জনগণকে তিনি উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান এবং এদের ‘শরণার্থী’ না বলে ‘ইউক্রেন থেকে আসা জনগণ’ বলে অভিহিত করেন।
এই অবস্থান শুধু রাজনীতিবিদদের নয়। ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের নিয়ে প্রতিবেদন এবং বর্ণনা করার সময় আল জাজিরার একজন ইংরেজি টেলিভিশন উপস্থাপকও একই অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি ইউক্রেনীয় শরাণার্থীদের সম্পর্কে বলেন, ‘এরা সমৃদ্ধশালী, মধ্যবিত্ত মানুষ। এরা স্পষ্টতই উত্তর আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের এলাকাগুলো থেকে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টাকারী শরণার্থী নয়। তারা দেখতে যে কোনও ইউরোপীয় পরিবারের মতো যে আপনি তাদের পাশে থাকবেন।’
যদিও চ্যানেলটি পরে দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়ে বলেছে যে, ওই মন্তব্য ‘সংবেদনশীল’ এবং ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ ছিল।
একই কাজ করেছে মার্কিন টেলিভিশন নেটওয়ার্ক সিবিএস নিউজও। তাদের এক সংবাদকর্মী নিউজে বলেছেন, কিয়েভের সংঘাত ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো নয় যেটি কয়েক দশক ধরে সংঘাত চলছে। এটি তুলনামূলকভাবে সভ্য, তুলনামূলকভাবে ইউরোপীয় শহর।
যদিও এটি প্রচার করার পরও সিবিএস টেলিভিশন ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
সূত্র: যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল পাবলিক রেডিও (এনপিআর)
আরইউ/এমএমএ/