সাকার মাছ খাওয়া ও চাষ নিষেধ
‘সাকার মাউথ ক্যাট ফিশ’। বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইপসতোমুস প্লেকসতোমুস’। সংক্ষেপে ‘সাকার মাছ’ বা ‘সাকার ফিশ’। মূলত অ্যাকুয়ারিয়ামের। খুব দ্রূত বংশবিস্তার করে। প্রধান খাবার জলজ পোকামাকড় ও জলজ শ্যাওলা। বাগে পেলে ছোট মাছ ও পোনা খাওয়ায় জুড়ি নেই। মাছটির পাখনা খুব ধারালো। শরীর শক্ত। ফলে আঘাত করে অন্য মাছগুলোকে ক্ষত করে ফেলে ও তার বিষে পচন ধরে এবং মাছগুলো মরে। শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপক ও তাদের ছাত্রছাত্রীদের সাকার মাছ নিয়ে গবেষণা নিয়ে আরো লিখেছেন তাদের ছাত্র রবিউল ইসলাম রাকিব
বাংলাদেশেও অ্যাকুয়ারিয়ামে শোভা বাড়ানোর জন্য চেয়েও সেখানের ময়লা খেয়ে পরিস্কার এবং শৈবাল খেয়ে পরিচ্ছন্ন ও পানির অক্সিজেন প্রবাহ তৈরির জন্য সাকার ফিশ নিয়ে আসা হয়েছে। তবে অ্যাকুয়ারিয়াম থেকে এখন ছড়িয়েছে ডোবা, নালাসহ নানা ধরণের জলাশয়ে। ফলে জলজ বাস্তুসংস্থানের অন্যান্য উপাদান নানা জাতের মাছের পোনা খেয়ে অ্যাকুয়ারিয়ামে গড়ে মোটে ১.৬৬ ফিটের রাক্ষুসে মাছটি আমাদের জলাভূমির সম্পদ উজাড় করে চলেছে ও বড় হচ্ছে। ফলে আমাদের মাছের জাতগুলো বাঁচাতে সাকার ফিশ নিয়ে গবেষণা করেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষক ছাত্র, ছাত্রীরা। এই দলের প্রধান ফিশারিজ, বায়োলজি অ্যান্ড জেনেটিকসের অধ্যাপক ও বিভাগী প্রধান ড. কাজী আহসান হাবীব। সহ-প্রধান ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট-হার্ভেস্ট টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাস্মদ মাসুদ রানা।
প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব বলেছেন, ‘সাকার মাউথ ক্যাটফিশ সহজেই নতুন পরিবেশে অভিযোজিত হয়। ফলে দ্রুত বংশবিস্তার করে। মাছটি যেকোনো ধরণের জলাশয়ে একবার ঢুকলে তাই এর বিস্তার রোধ করা খুব কঠিন। চাষের পুকুরেও মাছটি ঢুকলে অন্য জাতের মাছেগুলোর সঙ্গে খাবার ও বাসস্থানের প্রতিযোগিতায় নামে। এই মাছ পোনা ও ছোট মাছ খেয়ে ফেলে বলে বাইরের পর্যাপ্ত খাবার প্রদান করলেও উৎপাদন কাংখিত হতে পারে না। চাষযোগ্য মাছগুলো বিভিন্ন জলাশয়ের মতো সাকার ফিশের সঙ্গে খাবার এবং বাসস্থানের লড়াইয়ে টিকতে পারে না। মাছ চাষীরাও অন্যান্য জলাশয়ের মতো লোকসানে পড়েন।’
‘সাকার ফিশের ক্ষতিকর প্রভাবে ভারত, মায়ানমারসহ অনেক দেশের মৎস্যচাষী এবং জলাশয়গুলো ক্ষতিগ্রন্থ হয়েছে-আমরা জানি।’
অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব আরো বলেছেন, ‘আমাদের বাংলাদেশে শোভা বাড়ানো এবং কাঁচ, টিনের গায়ে এবং নীচে জন্মানো শ্যাওলা ও আবর্জনা খেয়ে পরিস্কারের জন্য সাকার ফিশের বর্ণিল ধরণ ও বিশেষ কালো জাত আমদানী করে আনা হয়েছে।’
‘তবে মানুষের ভুলে ও ভবিষ্যত না ভেবে ছড়িয়ে দেওয়ায় বাংলাদেশের ডোবা, নালাসহ নানা ধরণের জলাশয়ে হামেশা মাছটি পাওয়া যাচ্ছে। অথচ এই মাছটি বাংলাদেশের জলজ বাস্তুসংস্থানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে আমরা আগেই জানিয়েছি। আমাদের দেশী জাতের মাছের অস্তিত্বই তারা ধ্বংস করে ফেলবে।’
বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এই গবেষক বলেছেন, ‘সাকার মাছ প্রচুর খাবার খেয়ে চলে। ঢাকার নদী বুড়িগঙ্গাসহ অনেক বড় জলাশয়েও পাওয়া যাচ্ছে। তাই দেশীয় মাছগুলোর খাদ্যের জোগানে তারা তীব্র প্রতিযোগিতা তৈরি করছে। অন্য কোনো জলাশয়ে এই মাছটি যেন কোনোভাবেই ছাড়া না হয়, এই বিষয়ে সবাইকে আগ্রহী হতে হবে।’
‘আমাদের গবেষণায় আরো জানা গিয়েছে, অচেনা সাকার মাছের সঙ্গে আমাদের দেশের মাছের জাতগুলোর খাদ্য ও বাস্তুসংস্থানের প্রতিযোগিতাটিতে বাংলাদেশের মাছের জাতগুলো মারা পড়ছে। উন্মুক্ত জলাশয়গুলোতে দেশী মাছ ও পুকুরের চাষের মাছগুলো উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে।’
‘সাকার মাছ প্রজাতিগতভাবে প্রাকৃতিকভাবে জলাশয়ের খাদ্যশৃংখল নষ্ট করে দেয়। তারা জলজ বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করে। জলাশয়ে মাছের গায়ে ক্ষত তৈরি করে এবং মেরে উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দেয়। নোংরা জলাশয়কে পরিস্কারের বিরল গুণ আছে এই মাছের। আবার নোংরা পরিবেশে দ্রুততম বংশবৃদ্ধি করে। তবে এই সাকার মাছ ভালো জলাশয়ে ছড়িয়ে জলাশয়গুলোর দেশী মাছের ডিম এবং রেণুও খেয়ে ফেলে। তারা জলের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ নানা ধরণের ক্ষতি করে বলে আমাদের আশংকা আছে।’
তিনি বলেছেন, ‘আমাদের বাংলাদেশে পাওয়া গিয়েছে সাকার মাছগুলোর এমন প্রজাতিগুলো আমরা গবেষণা করে জেনেছি, এরা ১৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি বা প্রায় দেড় ফিট পর্যন্ত হচ্ছে। তবে আরো আশংকার কথা বলো, এই মাছের বেঁচে থাকার শক্তি এত বেশি যে তারা প্রায় একটি দিন বা ২৪ ঘন্টা বাঁচে। ফলে কোথায় এই মাছ যাচ্ছে সেই বিষয়ে খুব নজর রাখতে হবে।’
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাকার মাছ নিয়ে গবেষক দলের সহ-প্রধান ফিশিং অ্যান্ড পোস্ট-হার্ভেস্ট টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান মোহাস্মদ মাসুদ রানা জানিয়েছেন, ‘আমাদের মৎস্য অধিদপ্তর সাকার মাছকে কোনোভাবেই উন্মুক্ত এবং বদ্ধ কোনো ধরণের জলাশয়েই যাতে ছাড়া না হয় ও যেতে না পারে সেই নির্দেশ প্রদান করেছেন। মৎস্যখাতের সবাইকে এই দেখভাল করতে জানানো হয়েছে। এছাড়াও কোথাও কোনো সাকার মাছ পেলে সেটিকে মেরে ফেলতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই মাছ খাওয়া নিষিদ্ধ।’
কীভাবে সাকার মাছকে আমাদের জলাশয়গুলো থেকে কমানো সম্ভব হবে-এই প্রশ্নের জবাবে প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব বলেছেন, ‘এই মাছটি নতুন, ছোট ও দেখতে ভিন্ন ধরণের কালো বলে এই মাছের বিষয়ে আমাদের দেশের মানুষের কোনো আগ্রহ নেই। আমাদের গবেষণাতেও সাকারের গায়ে কোনো বিষের গ্রন্থি নেই। তবে এই মাছের চাষ ও আবাদ না করলে এবং মাছটিকে মনের খুশিতে বা অন্যকে ক্ষতিগ্রস্থ করার জন্য না ছাড়লে হলো।’
‘এই মাছ সাগরেও পাওয়া যায়।’
আপনাদের গবেষণায় মাছ হিসেবে এই সাকার মাছ কী ধরণের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে বলতে পারি-সাকার মাছের গায়ে মোটে ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ আমিষ থাকে। তবে সাধারণ মানুষ মাছটি খেতে পারবেন কী না বা খেলে ক্ষতিকর স্বাস্থ্যগত কোনো সমস্যায় পড়বেন কী না সেটি আরো গবেষণার বিষয়। এই গবেষণা শেষ না হলে না খাওয়া ভালো। খেতে আমি মানা করবো। তবে আমরা জেনেছি, সাকার মাছটি খাওয়ার যোগ্য হলেও সঠিক প্রচারণা ও বাজারজাতকরণের প্রয়োজন আছে। তার আগে আমাদের দেশের মাছগুলো প্রচারণা ও বাজার তৈরি করা প্রয়োজন। তবে এই সাকার মাছের চামড়া ও পাখনা বেশ ধারালো বলে আমাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে রান্না ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সতর্ক থাকতে হবে। দেশী মাছগুলোতে এই সমস্যাগুলো নেই। আমাদের বাংলাদেশের গবেষণার মাধ্যমে খাদ্য হিসেবে গণ্য করা হলে মাছের মাধ্যমে আমিষের চাহিদা পূরণ করার দিকে এগুনো যেতে পারে।’
‘যেহেতু বুড়িগঙ্গার মতো দূষিত নদীতে বেঁচে থাকতে পারে, ফলে এই সাকার মাছের আরো গবেষণা প্রয়োজন। আমরা এই গবেষণায় আছি। তার আগে খাবার বিষয়ে যাওয়া যাবে না। আমরা মানা করছি। আমরা আরো বলছি, বাংলাদেশে সকার ও এই ধরণের কোনো বাণিজ্যিক, শোভা বাড়ানো ও ক্ষতিকর হতে পারে, আমাদের অর্থনীতিতে ক্ষতিগ্রস্থ করে এমন কোনো মাছ ও মাছের জাত আমদানী করার কোনো দরকার নেই। আমাদের দেশের মাছগুলোই তো বাঁচতে পারছে না। বিদেশের মাছের কী দরকার? স্বাদও ভালো নয়, সাধ্যে কুলায় না প্রায় সবার।’
‘আমি বলবো, এই সাকার মাছের যেন আমাদের দেশে কোনো ধরণের কৃত্রিম প্রজনন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়।’
‘বিদেশ থেকে মাছ আমদানী ও অ্যাকুয়ারিয়ামে লালনের মাছের নীতিমালা ও কার্যকর পক্ষক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশ, জলাশয়গুলোর জন্য ক্ষতিকর ও দেশী মাছের জাতগুলোকে হুমকিতে ফেলতে পারে, এমন যেকোনো ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণের হাত থেকে বাঁচতে ও বাঁচাতে হবে। দেশী গবেষকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ও সবার কাছে জানিয়ে মাছ যেকোনো ধরণের কাজের জন্য আমদানী করতে হবে।’
বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোহাম্মদ মাসুদ রানা সবশেষে সাকার মাছের ক্ষতি নিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের দেশের জলাশয়গুলোর মাছগুলোকে মেরে ও খেয়ে ফেলা সাকার মাছ থেকে বাঁচতে সাকারকে শুটকি তৈরি করে পোল্ট্রি বা মৎস্য চাষের পুকুরে মাছের খাদ্যের আমিষের যোগানের ও খাবারের জন্য প্রদান করতে পারবেন। ফিশ মিলের ফিড হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করা দরকার। ফলে জলাশয়ের মাছগুলো অথনৈতিক উপযোগিতা তৈরি হবে। আমাদের মাছগুলো বাঁচবে। কমসংস্থান হবে।’
ওএস।