সিসিক নির্বাচন, আলোচনা-সমালোচনায় আনোয়ারুজ্জামান
শত মানুষের ভীড়ে তিনি শুধু একজনই নন, অন্যতম বটে। বিশালাকার দীর্ঘদেহী লোকটিকে আলাদা করে অবশ্যই চিনতে হবে বৈকি! আলোচনার টেবিলেও প্রাসঙ্গিক তিনি। কেউ বলেন 'ম্যাজিক ম্যান'। কারো কাছে তিনি সিলেটের রাজনীতির অন্যতম অভিভাবক। সমালোচনাও আছে। কেউ বলছেন, তিনি উড়ে এসে জোড়ে বসার চেষ্টা করছেন। আবার কেউ বলছেন তিনি সিলেটের স্থানীয় রাজনীতির কেউ নন। আর তাঁর অনুরাগীরা বলছেন, 'এই নগরীর প্রতিটি ইট-পাথর ওই নামটিকে ভালোভাবেই চিনে ও জানে।
প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার এই মানুষটি স্কুল জীবনে খেলাঘর কর্মী ছিলেন। কলেজ জীবনে এসে যোগ দেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। আওয়ামী রাজনীতির উত্থাল সময়েও সিলেটের রাজপথে সরব ছিলেন তিনি। দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনকালীন অন্যতম 'পলিসি ম্যাকার' হয়ে তিনি দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে সমর্থ হন। এমনকি উপজেলা পর্যায়েও কাজ করেছেন দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে। সুতরাং সিলেটে তিনি আগন্তুক নয়'।
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন (সিসিক) নিয়ে এই মুহুর্তে নগর জোরে এই নাম রয়েছে ব্যাপক আলোচনায়। পক্ষে-বিপক্ষে শুরু হয়েছে নানা সমালোচনা। যাকে নিয়ে এত আলোচনা সমালোচনা তিনি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। নগরের ৫৬/৯ পাঠানটুলা এলাকার বাসিন্দা আনোয়ারুজ্জামান সিসিকের ৯ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা। আরবিতে 'আনোয়ার' নামের অর্থ সুন্দর আলোকিত, স্পস্ট ও পরিচ্ছন্ন। অর্থের সাথে চেহারার মিল না থাকলেও অনুরাগীদের কাছে তিনি সবকটি গুনেই বিশেষিত। সিসিকে মেয়র পদে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলে কেমন হবে-এমনটি নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।
সাধারণ ভোটারদের অভিমত, দলীয় কোন্দলের কারণে সিসিকে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী পরাজিত হলেও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর ক্ষেত্রে সেটি ঘটার কোনো সুযোগ নেই। কারণ দলের সকলের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই কাজ করছেন তিনি। তাছাড়া এবারের সিসিক নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের একাধিক প্রার্থী রয়েছে। সেক্ষেত্রে তাদের যেকোনো একজনকে বেছে নেওয়া হলেও সাবেকি ধারার কোন্দলে মেয়র পদটি হারানোর শঙ্কা থাকবে আওয়ামী লীগে। এক্ষেত্রে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হলে কোন্দল অবসানের পাশাপাশি বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে শতভাগ।
নগরীর চালিবন্দরস্থ ১৫ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা দীনবন্ধু রায় দিপক বলেন, আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এমন একজন নেতা যিনি সিলেটের স্থানীয় রাজনীতির পাশাপাশি যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের অন্যতম একজন চালিকাশক্তি। একই সাথে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারকদের কাছেও বিশ্বস্থ একজন সিপাহশালার। দলীয় প্রধানসহ শেখ পরিবারের সাথে ঘণিষ্ট এই নেতা সিসিকের মেয়র পদে নির্বাচিত হলে নি:সন্দেহে সিলেটে উন্নয়ন বিপ্লব সাধিত হবে।
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর প্রাথমিক শিক্ষা সিলেট নগরীর রায়নগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর সিলেট সরকারি কলেজে ভর্তি হন উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে। বুরুঙ্গা হাইস্কুলে পড়াকালীনই তিনি চম্পাকলি খেলাঘর আসর ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও সংগঠক হিসেবে নিজের স্থান করে নেয়। তারপর সিলেট সরকারি কলেজে থাকাকালীন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। লন্ডনে এসে জড়িয়ে পরে যুবলীগকে সংগঠিত করার কাজে।
গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কারণে প্রথমে সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হয়। যুক্তরাজ্যে যুবলীগের বিশাল কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার পেছনে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর রয়েছে ঐতিহাসিক অবদান। সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্ব গুণে তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার গ্রেফতার করার পর তাঁর মুক্তির দাবিতে যুক্তরাজ্যব্যাপি আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ অগ্রণী ভূমিকা।
আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর রাজনীতির মূল ক্ষেত্র যুক্তরাজ্য হলেও সিলেটের রাজনীতিতে তিনি একজন পরিচিত মুখ। বিশেষ করে বিগত সিলেট সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বদর উদ্দিন আহমেদ কামরানের পক্ষে, সংসদ নির্বাচনে ড. মোমেনের পক্ষে ও সিলেট-৩ এর উপ নির্বাচনে হাবিবুর রহমান হাবিবের পক্ষে তার অবদান কোন অংশেই কম ছিল না। তার সতীর্থদের মধ্যে শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল বর্তমানে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও হাবিবুর রহমান হাবিব সিলেট-৩ এর সাংসদ।
গেল ২২ জানুয়ারি যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। ওই দিন সিলেট বিমান বন্দরে ছাত্রলীগ, যুবলীগ,স্বেচ্ছাসেবকলীগ,তাঁতী লীগ ও আওয়ামী লীগের হাজারো নেতাকর্মীর ঢল নামে সিলেট বিমানবন্দরে। পরে মোটর সাইকেলের একটি বিশাল বহর সঙ্গে নিয়ে নগরীতে প্রবেশ করেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এর মাত্র তিনদিন আগেই নগরীতে সিসিক মেয়র হিসেবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হচ্ছেন আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী-এমন বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। তবে বিমানবন্দরে হাজারো নেতাকর্মী ও গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে আনোয়ার চৌধুরী সে ব্যাপারে মুখ না খুলে বরং অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা জানালেন দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি।
একই সাথে তিনি বলেন, এই শহরের উন্নয়নে, বিপদে, দুর্যোগ-দূর্বিপাকে বিগত দিনে নগরবাসীর পাশে ছিলেন, সিলেটের জননন্দিত সাবেক মেয়র (মরহুম) বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। বর্তমানেও কাজ করে যাচ্ছেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ, এটি এম হাসান জেবুল, সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আরমান আহমদ শিপলু। তাদের প্রত্যেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন রাজনীতির সুফল পবিত্র এই নগরে পৌছে দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
বিশেষ কোনো বার্তা পেয়ে সিলেট এসেছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বিমানবন্দরে এই নেতা জানান, প্রতিটি নির্বাচনের আগেই আমি সিলেটমুখী হই, এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। তাছাড়া, যেহেতু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং সিসিক নির্বাচনও সমাগত সে হিসেবে নগরে আমার আগমণ অহেতুক নয়। আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবিত একজন মানুষ। তারই সুযোগ্য কন্যা দলীয় প্রধানের নির্দেশ অনুযায়ী কল্যাণ ধারার রাজনীতিতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই। সে হিসেবে নেত্রী শুধু আমাকেই নয়, দলের যাকেই যেখানে কাজে লাগাবেন সেখানেই একজোট হয়ে কাজ করতে পারলে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষ আওয়ামী রাজনীতির শতভাগ সুফল পেতে সক্ষম হবেন।
এদিকে সিলেট আসার দুই দিন পর তিনি রাজধানীতে গিয়ে দেখা করেন দলীয় প্রধানের সাথে। একই সাথে দলীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সিলেট ১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গেও দেখা করেন। ফিরে এসে গণমাধ্যম কর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দলীয় প্রধান আমাকে মাঠে কাজ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। তিনি কোথায় কা কে কাজে লাগাবেন, একমাত্র তিনিই জানেন। তাছাড়া, সকলেরই জানেন আমি বিগত দুই দুইবার সিলেট-২ আসনে সংসদ নির্বাচনের জন্য দলীয় মনোনয়ন চাই। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন পাই নি।
এক প্রশ্নের জবাবে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী জানান, যুক্তরাজ্য থেকে দেশে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব ও সিলেটের কৃতি সন্তান নজিবুর রহমান, ড. ফরাস উদ্দিন,সিএম কয়েস সামি, ড. এ কে আবদুল মোমেনসহ দেশের একাধিক স্বনামধ্যন্য লোকজন ফোনে শুভকামনা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমি জানি না। মানুষ কেন আমাকে এত ভালোবাসে। আমি সকলের ভালোবাসা ও দোয়া মাথায় তোলে নিলাম। এই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে নিজেকে শেষ দিন পর্যন্ত প্রস্তুত রাখতে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ'।
সিসিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দীর্ঘদিন থেকে যারা কাজ করে যাচ্ছেন, তাঁরা আপনাকে মেনে নেবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিসিক নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রশ্নটি আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ আমি প্রার্থী হিসেবে নিজেকে উল্লেখ করতে চাই না। সবাই দলের হয়ে কাজ করেন, কিছু পাওয়ার জন্য।
প্রার্থী হিসেবে যাদের নাম ঘোষণা করলেন, তাদের মধ্যে আমার নেতা, সহকর্মী ও অনুজ রয়েছেন। সে হিসেবে দলীয় প্রধানের সিদ্বান্তই এক্ষেত্রে চূড়ান্ত। আর মেনে নেয়ার বিষয়টি এখানে যায় না। কারণ যারা আওয়ামী আদর্শ ধারণ করেন, তাদের মধ্যে অভিমান সৃষ্টি হলেও বিভাজন থাকে না। দিনশেষে সবাই হয়ে যায় জাতির পিতার আদর্শে উজ্জীবিত এক একটি ভ্যানগার্ড।
এএজেড