দিবস আসে-যায় নদীগুলো ফিরে পায় না নাব্য
যে নদীর বুকে একদিন জাহাজ চলত, তার বুকে এখন জেগে উঠেছে চর। গাঁয়ের বধূদের কলসি কাঁখে করে নদী থেকে পানি তোলার সেই মনোরম দৃশ্যও আর নেই। নদীকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্যের সরগরম অবস্থা এখন যেন একেবারেই কল্পনাতীত।
দখল-বাণিজ্য আর দূষণের অরাজকতায় নাব্য হারিয়ে এক একটি নদী রূপ নিয়েছে মরা খালে। সিলেটের খরস্রোতা দীর্ঘতম নদী সুরমা রয়েছে অস্তিত্ব সংকটে। সেভেন সিস্টারের জাহাজ চলা কুশিয়ারা রূপ নিয়েছে মরা খালে। গতিপথ হারাচ্ছে জাফলংয়ের পিয়াইন, ডাউকি ও ভোলাগঞ্জের ধলাই নদী। নুড়ি-পাথরের মিশ্রিত পানির ঢলের কারণে সুনামগঞ্জের যাদুকাটা নদী চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দখলদারদের কবলে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে হবিগঞ্জের সুতাং নদীও।
আজ ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবস। প্রতি বছরই দিবসটি আসে যায়। পালিত হয় দিবস। কিন্তু বদলায় না নদীর চেহারা। সিলেট এখন নদী বিপর্যয়ের এলাকা। দখলে দূষণে ভরে যাচ্ছে নদী। এক সময়ের খরস্রোতা সুরমা নাব্য হারিয়ে এখন যেন মরা গাঙ।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ৩৯৯ কিলোমিটার দীর্ঘ সুরমার উৎসমুখ জকিগঞ্জের আমলশীদ থেকে কানাইঘাট উপজেলার লোভাছড়ার সংযোগস্থল পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার এলাকায় চর জেগেছে ৩৫টি। সিলেট নগর সংলগ্ন কুশিঘাট, কুশিটুক, শ্রীরামপুর কাজিরবাজার শহরতলীর মেন্দিবাগ নদীগর্ভে চর জেগে মাঠে পরিণত হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে জেগে ওঠা চরে সবজি চাষ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এই সময় বন্ধ হয়ে যায় নৌযান চলাচল।
চলতি বছরের তিন দফা বন্যায় সর্বনাশা রূপ ধারণ করে সিলেট। এরপর থেকে নদী খননের বিষয়টি আলোচনায় আসে জোরেসোরে। বন্যার জন্য সুরমার নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়াকে দায়ী করেন সংশ্লিষ্টরা। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সুরমার দুই তীর ছাপিয়ে ডুবিয়ে দেয় সিলেট শহর। দীর্ঘদিন নদী খনন না করায় বেশি ভুগতে হয় শহর ও এ অঞ্চলের সুরমা তীরবর্তী মানুষকে। অথচ ১০ বছরে সিলেটের সুরমা নদী খননে চারটি প্রকল্প নেওয়া হয়। কিন্তু সুরমা খননে নেওয়া কোনো প্রকল্পই আলোর মুখ দেখেনি।
গত ১৮ মে সিলেটে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও বলেন, ‘সুরমা নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় পানি আটকে থাকছে। এই নদী খনন করতে হবে।’
আগামী বর্ষার আগেই নদী খনন করা হবে উল্লেখ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সিলেটের নদীগুলো খননের ব্যাপারে আমাদের সরকার ও প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক। আমরা নদী খননের পরিকল্পনা নিয়েছি। আগামী বর্ষার আগেই নদীগুলো খনন করতে হবে। তবে বর্ষার আগে আদৌ নদী খনন সম্ভব হবে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন বিশ্লেষকদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সিলেটের অন্যতম প্রধান নদী সুরমা ও কুশিয়ারা ড্রেজিং করতে দু'টি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রকল্পের আওতায় ড্রেজিংয়ের পাশাপাশি নদী দু'টোর উভয় তীর সংরক্ষণ, বেড়িবাঁধ নির্মাণ, নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ আনুষঙ্গিক উন্নয়নও করা হবে। এতে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৩১৭ কোটি ২৮ লাখ টাকা। মেগা এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সিলেট মহানগরসহ সিলেট সদর উপজেলা, দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলা স্থায়ীভাবে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। তবে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন কতদূর তা নিয়ে অপেক্ষায় নদী বিশ্লেষকরা।
এ অবস্থায় দেশের নদী রক্ষায় ও কমিশনের কার্যক্রম শক্তিশালী করতে প্রত্যেক সিলেটসহ প্রত্যেক বিভাগে আঞ্চলিক কার্যালয় চায় নদী রক্ষা কমিশন। নতুন এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হলে নদী রক্ষায় গতি আসবে বলে মনে করছেন কমিশন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়নের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
এখন শুধু ঢাকায় নদী রক্ষা কমিশনের কার্যালয় রয়েছে। দেশের আর কোথাও অফিস না থাকায় কাজের জন্য জেলা প্রশাসকদের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু রুটিন কাজের বাইরে গিয়ে তাদের নদী রক্ষার কাজ করতে হয় বলে এ খাতে আশানুরূপ কাজ হয় না।
কমিশন সূত্র জানায়, শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনে মোট ৪১২ জন নিয়োগ দেওয়া হবে। এর মধ্যে ঢাকায় কেন্দ্রীয় অফিসে ৫২ জন নেওয়া হবে। সিলেটসহ ৮ বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হবে ৩২৮ জন। কিন্তু এখনো এটির কাজ এগোয়নি বলে জানা গেছে। নদী রক্ষার কাজে জড়িত অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), পানি উন্নয়ন বোর্ড, নদী রক্ষা কমিশন ও জেলা প্রশাসন।
এসএন