ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা চা শ্রমিকদের
চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিতে চলমান শ্রমিক ধর্মঘট ষষ্ঠ দিনের মত চলছে৷ আজ সকাল থেকেই দেশের প্রতিটি চা বাগানে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ করেন শ্রমিকরা৷ দুপুরে শ্রমিকরা ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের শায়েস্তাগঞ্জে সড়ক অবরোধ করে রাখে, পরে পুলিশ এসে তাঁদের সেখান থেকে সরে যেতে অনুরোধ করলে শ্রমিকরা বাগানে ফিরে যান৷
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায়ও সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন চা শ্রমিকরা,কুলাউড়ার ব্রাহ্মণবাজার চৌমোহনা ও নবীনচন্দ্র বিদ্যালয়ের সামনে সড়ক আটকে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন শ্রমিকরা৷ মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্রগ্রামসহ দেশের সবগুলো বাগানে দশম দিনের মত চলছে আন্দোলন, আর ধর্মঘটের পেরিয়ে গেছে ছয় দিন৷
বাগানগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে চায়ের এই ভরা মৌসুমে চা বাগানগুলোতে বিরাজ করছে শূন্যতা৷ কারখানাগুলো রয়েছে বন্ধ, সবুজ কচি পাতাগুলোও রয়ে গেছে গাছেই৷ শ্রমিকরা দল বেঁধে একজায়গায় বসে নানান স্লোগান দিচ্ছেন, মালিকদের কাছে দাবী জানাচ্ছেন তাঁদের মজুরি বৃদ্ধির৷ এদিকে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবীতে চলমান ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষনা দিয়েছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন৷
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বৃহস্পতিবার বিকেলে গণমাধ্যমকে জানান,আমরা আজ চা বাগানের সাতটি ভ্যালীর সবাপতি সম্পাদক ও বাগান পঞ্চায়েত প্রধানদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলাম৷ গতকাল ঢাকায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের বিষয়ে আমরা তাঁদের জানিয়েছি৷ চা শ্রমিকরা বলেছেন প্রয়োজনে আমরা একমাস না খেয়ে থাকবো তবুও আমরা তিনশ টাকা মজুরি বৃদ্ধির দাবী থেকে সরে আসবো না৷
এদিকে গতকালকের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের ব্যাপারে জানাতে চা শ্রমিক ইউনিয়ন সাত ভ্যালীর সঙ্গে আজ দুপুরে মৌলভীবাজারের চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বৈঠকে বসে৷ সেখানে গতকালকে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেওয়া প্রতিনিধিদল গতকালকের বৈঠকের ব্যাপারে বাগান পঞ্চায়েত কমিটিগুলোকে অবহিত করে৷ বৈঠকে বালিশিরা ভ্যালীর ৬৪টি চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন৷ বৈঠকে বিভিন্ন বাগানের পঞ্চায়েত প্রধানরা বক্তব্য দেন৷
পারকুল চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি রিপন দেব বৈঠকে বলেন, সাধারন চা শ্রমিকরা আমাদের দিকে চেয়ে বসে আছে৷ আমরা ২০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির দাবি মেনে নিয়ে চা শ্রমিকদের সাথে বেঈমানী করতে পারবো না৷ মির্জাপুর চা বাগানের পঞ্চায়েত সভাপতি দেশান্ত গোয়ালা বলেন,২০ টাকা মজুরি বৃদ্ধির দাবী মেনে নিলে আমাদের আন্দোলনকারী চা শ্রমিক মা-বোনদের কাছে আমরা দালাল হিসেবে স্বীকৃতি পাবো৷ নায্য মজুরি আমাদের অধিকার তাই আমরা তিনশ টাকা মজুরির নিচে কোন কথা মানবো না৷
এদিকে চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে সরকার, চা বাগান মালিকপক্ষ ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকটি গতকাল রাতে কোন সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয়েছে৷ গতকাল বিকেলে ঢাকায় শ্রম অধিদপ্তর কার্যালয়ে শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরীর মধ্যস্ততায় এই বৈঠক শুরু হয়৷ ছয় ঘন্টাব্যাপি চলা এই বৈঠকে কোন সমঝোতায় পৌছাতে পারেনি কোন পক্ষই৷ বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি পংকজ কন্দ জানিয়েছেন,সমঝোতা বৈঠকটি কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে৷ চা শ্রমিকরা তাঁদের চলমান ধর্মঘট কর্মসূচী অব্যাহত রাখবেন৷
পংকজ কন্দ আরো জানান, শ্রম অধিদপ্তরের ডিজি মহোদয়ের মধ্যস্ততায় আমরা বসেছিলাম কিন্তু আমরা যেটা প্রত্যাশা করেছিলাম সেটি হয় নি৷ তবে আলোচনার দুয়ার খোলা থাকবে আমাদের পক্ষ থেকে পাশাপাশি আমাদের আন্দোলন কর্মসূচীও চলমান থাকবে৷ মালিকপক্ষ বৈঠকে যে মজুরি প্রস্তাব করেছেন সেটি তিনশ টাকার ধারের কাছেও না, তাই আমাদের কাছে এই প্রস্তাব গ্রহনযোগ্য নয়৷ আমাদের মা বোনেরা রাজপথে যে দাবী নিয়ে আন্দোলন করছে সেই দাবী যেহেতু পূরন হয় নি তাই আমরা ডিজি মহোদয় কে আজ বা কাল মালিকপক্ষের এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করার কথা জানিয়ে দিবো৷
চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা জানান, গতকাল সারাদিন ব্যাপি আমরা বৈঠক করেছি৷ মালিক পক্ষ শ্রমিকদের মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৪০ টাকা প্রস্তাব করেছিলেন ,আমরা এই মুহূর্তে এই প্রস্তাবটি প্রত্যাখান করছি৷ বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান শাহ আলম বলেন,শ্রমিকপক্ষ ২ দিনের সময় নিয়েছে তারপর তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্ত জানাবে৷
তবে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক নিপেন পাল বলেছেন,আমরা কোন সময় নেই নি কারো থেকে৷ আমাদেরকে আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বলা হয়েছিলো এবং ১৪০ টাকা মজুরি দেওয়ার কথা বলেছিলেন৷ আমরা বলেছি সরকারের ডাকে আমরা এখানে এসেছি,আমরা আলোচনা করতে পারি কিন্তু আমাদের আন্দোলন চলমান থাকবে৷
শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী গতকাল গণমাধ্যম কে বলেছিলেন,আমরা যে আলোচনা গতকাল করেছি মালিকপক্ষ ও শ্রমিকপক্ষের সাথে আমাদের আলোচনা অব্যাহত আছে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয় নি৷ উনারা (শ্রমিকপক্ষ) একদিন সময় চেয়েছেন আজ উনারা স্থানীয় নেতাদের সাথে বসে একটা সিদ্ধান্ত জানাবেন৷
এদিকে চলমান শ্রমিক ধর্মঘটের কারনে কাঁচা চা পাতা ও রাবারের লেটেক্স (কষ) নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ৫ টি চা বাগানের পক্ষ থেকে পাতা নষ্ট ও রাবারের কষ নষ্টের বিষয়টি জানিয়ে থানায় সাধারন ডায়েরি করা হয়েছে। সাধারণ ডায়েরির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শ্রীমঙ্গল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হুমায়ুন কবির।
শ্রীমঙ্গল থানায় করা সাধারণ ডায়েরি থেকে জানা যায়, মজুরি বৃদ্ধির দাবীতে চলমান শ্রমিক ধর্মঘটের কারনে কাঁচা চা পাতা নষ্ট হচ্ছে যে সব বাগানে তারমধ্যে রাজঘাট চা বাগানের কারখানায় ১ লক্ষ ৪৮ হাজার ৭৩৫ কেজি, ডিনস্টন চা বাগানের কারখানায় ৯৯ হাজার ২৫০ কেজি, বালিশিরা চা বাগান কারখানায় ৫০ হাজার ২০৭ কেজি, আমরাইল চা বাগান কারখানায় ৫ হাজার ৬৮৩ কেজি কাঁচা চা পাতা নষ্ট হয়ে গেছে৷ অপরদিকে জাগছড়া চা ববাগানে ২ হাজার ৩০৫ লিটার লেটেক্স (কষ) নষ্ট হয়ে গেছে। শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকে কাজ বন্ধ রাখায় উত্তোলিত চা পাতা ও রাবারের কস গুলো প্রক্রিয়াজাত করা যাচ্ছে না৷ তাই এই কাঁচা পাতাগুলো ও কষ কারখানায় থেকে নষ্ট হচ্ছে এবং এতে চা কোম্পানির কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে৷
সাধারণ ডায়েরির বিষয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের অর্থ সম্পাদক পরেশ কালিন্দি বলেন, এই চা পাতা নষ্ট হওয়ার পিছনে মালিক পক্ষই দায়ী। আমরা আন্দোলনে যাওয়ার আগে মালিক পক্ষকে মজুরি বাড়ানোর জন্য আল্টিমেটাম দিয়েছিলাম পরবর্তীতে তারা টানা চার দিন মাত্র দুই ঘন্টা কর্মবিরতি দেন। তখন চা শ্রমিকরা কর্মবিরতি করেও বাগানের সব কাজ করেছেন।
দুই ঘন্টার কর্মবিরতি করেও তারা চা বাগানের ক্ষতি করেননি। তাদের দাবী তখনই মেনে নেয়া বা তাদের সাথে সমঝোতা বৈঠকে মালিক পক্ষ বসলে আজকের ধর্মঘটের প্রয়োজন পড়তো না। মালিক পক্ষ ইচ্ছে করেই কালক্ষেপণ করেই চায়ের ক্ষতি করছে। গত ১৯ মাস ধরে মজুরি সমস্যার সমাধান না করে যে ক্ষতি হয়েছে সেটার জন্য মূলত বাগান কর্তৃপক্ষ দায়ী৷
শ্রীমঙ্গল থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) হুমায়ুন কবির বলেন, শ্রীমঙ্গলের রাজঘাট চা বাগান, ডিনস্টন চা বাগান, আমরাইল ছড়া চা বাগান, বালিশিরা চা বাগান ও জাগছড়া চা বাগান এই ৫ টি চা বাগানের সহকারী ব্যবস্থাপকরা বাদী হয়ে শ্রীমঙ্গল থানায় গত মঙ্গল ও বুধবার রাতে আলাদা আলাদা ভাবে সাধারণ ডায়েরি করেছেন। আমরা আদালতের অনুমতি নিয়ে এই সাধারন ডায়েরিগুলোর ব্যাপারে তদন্ত করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিবো৷
এএজেড