সাতছড়ি উদ্যানের আয়তন বাড়ছে দ্বিগুণ
হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে অবস্থিত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সংরক্ষিত প্রাকৃতিক একটি বনাঞ্চল। সাতছড়ি দেশের সবচেয়ে ছোট জাতীয় উদ্যান। তবে ছোট হলেও এই বনকে বলা হয় বন্যপ্রাণীর ‘হটস্পট’। বিশেষ করে পাখির রাজ্য হিসেবে পরিচিত এই বনে আছে অনেক বিলুপ্ত বন্যপ্রাণী। এই বনে দেখা মিলেছে বন্যককুরের। এটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ও অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি।
প্রকৃতির আপন মায়ায় সুনিপুণভাবে বেড়ে ওঠা এই বন হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের গাঁ ঘেঁষে অবস্থিত। মিশ্র চিরসবুজ এই বন আঁকা-বাঁকা ৭টি পাহাড়ি ছড়া ও উঁচু-নিচু পাহাড়ি টিলায় পরিবেষ্টিত। বনাঞ্চলটিকে ঘিরে রয়েছে ৯টি চা বাগান। পশ্চিমে সাতছড়ি চা বাগান ও পূর্ব দিকে চাকলাপুঞ্জি চা বাগান।
বর্তমান সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ২৪২ দশমিক ৯১ হেক্টর সংরক্ষিত বন। তবে এবার বনটির আয়তন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বনবিভাগ। নতুন করে ৬০০ হেক্টর সংযোজন করে মোট ৮৪২ দশমিক ৯১ হেক্টর জাতীয় উদ্যান করতে চায় বনবিভাগ। এরই মধ্যে এ নিয়ে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সিলেট। প্রস্তাবটি বন অধিদপ্তর থেকে যাচাই বাচাই শেষে প্রয়োজনীয় তথ্য সমৃদ্ধ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, সাতছড়িতে প্রায় ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। বড় আকারের স্তন্যপায়ীদের মধ্যে রয়েছে লেজবিহীন স্তন্যপায়ী উল্লুক। পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া এ মহাবিপন্ন উল্লুকের অন্যতম উপযুক্ত আশ্রয়স্থল সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। অন্যান্য বড় আকারের স্তন্যপায়ীদের মধ্যে রয়েছে চার প্রজাতির বানর। এগুলো হলো- রেসাস বানর, ছোট লেজী বানর, আসামি বানর ও লজ্জাবতী বানর। এ ছাড়া দুই ধরনের হনুমান রয়েছে এখানে। এগুলো হলো- মুখপোড়া হনুমান ও চশমাপরা হনুমান। এ ছাড়া অন্যান্য স্তন্যপায়ীর মধ্যে রয়েছে বিপন্ন প্রজাতির মায়া হরিণ, কালো কাঠবিড়ালী, খরগোশ, বন্যশুকর, শিয়াল, মেছোবিড়াল, বনবিড়াল, গন্ধগোকুল, সজারু, হল্দে-গলা মার্টিন।
সাতছড়িতে বন কুকুর রয়েছে জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ও মাংসাশী প্রাণীর গবেষক মুনতাসির আকাশ বলেন, এটি খুবই সমৃদ্ধ বন। এখানে অনেক বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। এই বনের আয়তন বাড়ানোর যে উদ্যোগ বনবিভাগ নিয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন হলে বন্যপ্রাণীদের থাকার জায়গা বাড়বে সেই সঙ্গে এদের সংরক্ষণে সহযোগী হিসেবে কাজ করবে এ উদ্যোগ।
সাতছড়িতে প্রায় ১৪৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। বিরল প্রজাতির বেশ কিছু পাখির দেখা মিলে এ বনে। এদের মধ্যে রয়েছে বনমোরগ, মথুরা, কাউধনেশ, পাহাড়ি ময়না, লালমাথা টিয়া, হরিয়াল, রাজ ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, বেগুনি পাপিয়া, সিঁদুরে মৌটুসি, লালমাথা কুচকুচি, পাতা বুলবুলি। অন্য পাখির মধ্যে রয়েছে বাংলা বুলবুলি, বউকথাকও, সিপাহি বুলবুলি, নীলকণ্ঠ, কালাঝুটি বুলবুলি, কোকিল, কাঠঠোকরা, দাগি বসন্ত, এশীয় নীলপরি, ঘুঘু, শ্যামা, কাঠ শালিক, সবুজ টিয়া, কমন ময়না, প্যাঁচা, ফটিকজল, ঈগল, বটকল, কমলা দামা, খয়রা মাথা সুইচোরা, মৌটুসি, ফুলঝুরি, গোলাপি সাহেলী, ভিমরাজ, ডুফাজঙ্গল, মুনিয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া শকুনের নিরাপদ এলাকা-১ এর অন্তর্গত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান শকুনের জন্য নিরাপদ এলাকা বলে ঘোষিত।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের তথ্য অনুযায়ী, যেকোনো বনে প্রতি এক কিলোমিটারের ভেতর সাধারণত ৫০ প্রজাতির বেশি পাখি বসবাস করে। কিন্তু সাতছড়ি একমাত্র বন যেখানে এক কিলোমিটারের ভেতর প্রায় ২০০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। অনেক বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির পাখিও পাওয়া যায় এখানে। তাই দেশের পাখিপ্রেমী ও ফটোগ্রাফারদের কাছেও এই বন রয়েছে পছন্দের তালিকায় একেবারে শীর্ষে।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের সহসভাপতি তারেক অনু জানান, দেশের মধ্যে পাখিদের জন্য এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ উদ্ভিদ আর বৃক্ষে ভরা বন আর কোথাও নেই। সুন্দরবনের পর একসঙ্গে এত প্রজাতির পাখির দেখা আর কোথাও মেলে না।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা পাখিবিদ ড. ইনাম আল হক জানান, এক কিলোমিটার বনে ৫০ প্রজাতির জায়গায় সাতছড়িতে ২০০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। এটা মোটেও ভালো খবর নয়। এত বড় দেশ আমাদের। কিন্তু পাখিদের বসবাসের ভালো জায়গা না থাকায় সেগুলো এখানে থেকে যায়। বনটি বড় করা হলে অবশ্যই পাখিদের জন্য ভালো খবর।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে বনটি আমার কাছে খুবই প্রিয়। কারণ এখানে এত বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছ, লতাপাতা আছে সেই সঙ্গে আছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ। যা এই বনকে সমৃদ্ধ করেছে। ছোট একটি বনে ২০০ প্রজাতির পাখি তখনই থাকবে যখন তাদের জন্য আলাদা আলাদা খাবার পাওয়া যাবে। এটা একটা ভালো দিক।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে প্রায় ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১০ প্রজাতির উভচর প্রাণীর রয়েছে। এদের মধ্যে সবুজ বোড়া বা পিট ভাইপার, কিং কোবরা, অজগর, মক ভাইপার, খয়ে গোখরা, শঙ্খিনী, লাউডগা, বাদামি গেছো সাপ, তক্ষক, গিরগিটি, চিতি বন আচিল, গুইসাপ, হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপসহ রয়েছে নানান সরীসৃপ।
উভয়চের মধ্যে চিত্রিত আঁচিল ব্যাঙ, ভেনপু ব্যাঙ, মুরগি ডাকা ব্যাঙসহ রয়েছে ঝিঁঝিঁ ব্যাঙ, সোনা ব্যাঙ, গেছো ব্যাঙ, দুই দাগী বাঁশি ব্যাঙসহ নানা প্রজাতির ব্যাঙ।
সরিসৃপ গবেষক শাহারিয়ার সিজার জানান, আয়তন বাড়ানো ভালো উদ্যোগ তবে এই বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া পাহাড়ি ছড়াগুলো অনেকটাই ভরাট হয়ে গেছে। ছড়া খনন ও দখলমুক্ত করা সেই সঙ্গে বনকে আরও সমৃদ্ধ করতে পারলে সরিসৃপ ও উভয়চর প্রাণীর জন্য উপকারে আসবে।
এই বনের অন্যতম সুন্দর প্রজাপতি। প্রায় ১৯০ প্রজাতির রংবেরঙের প্রজাপতির আবাসস্থল এ সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। বর্ণিল রঙিন ডানা, আকার-আকৃতি, বসার স্থান, খাদ্যাভাস ও উড়ার ধরনে একটি অন্যটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বিরল প্রজাতির বেশ কিছু উদ্ভিদসহ প্রায় ২০০ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে সেগুন, চাপালিশ, চালমুগরা, তেলসুর, আউয়াল, চিকরাশি, গামার, গর্জন, রাতা, উদাল, আগর, ছাতিম, লোহাকাঠ, ডেউয়া, বেলপাই, মালাকানা, মেহগনি, জিগা, জারুল, করই, ডুমুর, বট, পাকুরসহ রয়েছে নানান প্রজাতির উদ্ভিদ।
সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের বনাঞ্চলটিকে বর্ধিতকরণের যৌক্তিকতা হিসেবে বিভাগীয় বনকর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী জানান, বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য এই বনের আয়তন বাড়ানোর প্রস্তাব আমরা বন অধিদপ্তরে দিয়েছিলাম এই বছরের শুরুতে। এরপর অধিদপ্তর থেকে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য চাওয়া হলে আমরা আবার তা পাঠাই। বর্তমানে এটি অধিদপ্তর থেকে মন্ত্রণালয়ে আছে।
বাংলাদেশের অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য ও অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি হিসেবে খ্যাত সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান। দেশের অন্যান্য প্রাকৃতিক বনের তুলনায় এটি উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যে অত্যন্ত পরিপূর্ণ। ইতোমধ্যেই পৃথিবীর অনেক দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া মহাবিপন্ন বন্যপ্রাণীর একটু অংশ এখানে আছে। তাই এইসব বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণের জন্য জাতীয় উদ্যানের আয়তন বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।
তিনি আরও জানান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে বন্যপ্রাণীর নিরাপদ বিচরণের জন্য আবাসস্থল সংরক্ষণের গুরুত্ব অত্যাধিক।বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্র যথেষ্ট নয়। বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও এদের অবাদ বিচরণের জন্য বন্যপ্রাণীর স্থায়ী অভয়াশ্রম সৃষ্টি করা জরুরি। বিভিন্ন ধরনের ফলজ ও বনজ বৃক্ষ অর্থাৎ বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ও খাদ্যাপযোগী বনায়ন সৃজন করে বন্যপ্রাণীর খাদ্য ও আবাসস্থল নিশ্চিতকরণ প্রয়োজন। সেজন্য বনাঞ্চলের আয়তন বর্ধিতকরণ জরুীর।
রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, বর্তমানে যে আয়তন তার বাইরে জাতীয় উদ্যানের বর্তমান এলাকার বাইরের অঞ্চলেও বিভিন্ন ধরনের বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। এসব উদ্ভিদের মধ্যে চালমুগরা, তেলসুর, আউয়াল, চিকরাশি, গামার, রাতা, উদাল, আগর, ছাতিম, লোহাকাঠ, ডেউয়া, বেলপাই, মালাকানা, জিগা, জারুল, করই, ডুমুর, বট, পাকুর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উদ্যানের আয়তন বৃদ্ধির মাধ্যমে এসব উদ্ভিদের রক্ষণাবেক্ষণ আরও সহজতর হবে। পাশাপাশি জাতীয় উদ্যানটিও হবে সমৃদ্ধ।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খানা জানান, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের আয়তন বর্তমানে খুবই ছোট। এত কম জায়গাতে দীর্ঘদিন বন্যপ্রাণী টিকিয়ে রাখা কঠিন তাই আয়তন বাড়ানো জরুরি। এই বনের আশেপাশের অনেক এলাকা বন্যপ্রাণীদের জন্য সমৃদ্ধ। সেই সব জায়গাকে সংরক্ষিত বনের আয়তায় আনার যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা বন্যপ্রাণীর জন্য উপকারে আসবে। কারণ জায়গা বাড়লে প্রাণীদের আবাস্থল বাড়বে এবং এই জায়গাটা সংরক্ষিত হবে। এদের তাদের প্রজনন ও চলাচলের জন্য নিরাপদ জায়গা বৃদ্ধি পাবে।
এসএন