কাজ শেষের আগেই ২৭ কোটি টাকার সেতুর পিলারে ফাটল
রংপুরের পীরগঞ্জে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই নুনদহ সেতুর নিচে পিলার ব্যাচে বড় ধরনের ফাটল দেখা গেছে। সেতুটি করতোয়া নদীর উপর নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন সেতুটির স্থায়িত্ব ও কাজ সমাপ্তি নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে অনিশ্চয়তা। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বেশ কিছুদিন ধরে নির্মাণ কাজ স্থগিত রেখেছে। এরই মাঝে সেতুর মূল পিলার ব্যাচে ফাটল দেখা দেওয়ায় ক্ষুদ্ধ স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার, রংপুরের এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বহীনতা ও লুটপাটের কারণে সেতুর নিচে পিলারে ফাটল ধরেছে। সেতুর নির্মাণ কাজে কর্তৃপক্ষের গাফলতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি তুলেছেন সচেতন মহল।
জানা গেছে, ২০১৮ সালে করতোয়া নদীর নুনদহ ঘাটে ৩০১ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৯ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের এই সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিপি এল জেভি ৫২ ছাত্তার ম্যানসন ও প্যান্স লাইন্স। শর্তানুযায়ী ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত নুনদহ ব্রিজের মাত্র ৭০ শতাংশ সম্পন্ন করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে ২ বছর ধরে নির্মাণ কাজ স্থগিত রেখেছে। সম্প্রতি নদীর পানি শুকিয়ে গেলে সেতুটির ৫ নম্বর পিলারটির বেজমেন্ট ফেটে মাটির নিচে ধসে পড়ে যায়। সেতুর নিচে হঠাৎ পিলারে ফাটল দেখা দেওয়ার ঘটনাটি জানাজানি হলে তোলপাড় শুরু হয়। পরে এলজিইডির পীরগঞ্জ উপজেলা কর্মকর্তাদের টনক নড়তে শুরু করে। এ ঘটনায় গত ৩০ এপ্রিল ঢাকা থেকে তিন সদস্যদের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি সেতুটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এ সময় স্থানীয় লোকজন সেতুর কাজের গুণগত মান, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার ও বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে রংপুর এলজিইডি জড়িত বলে জানায়। তবে ফাটল দেখা দেওয়া অংশের কারণে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ কিনা বা এর ভবিষ্যৎ কি তা স্পষ্ট করেন পরিদর্শনে আসা তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
এলজিইডি সূত্রে আরও জানা গেছে, জাতীয় সংসদের স্পিকার ও রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী পীরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমাঞ্চল এবং দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ ও বিরামপুর উপজেলার মানুষের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে করতোয়া নদীর উপর সেতু নির্মাণে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশ দেন। নির্দেশের আলোকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) আওতায় সিআইবি প্রজেক্টের মাধ্যমে করতোয়া নদীর উপর চতরা জিসি গিলাবাড়ী ঘাট ভায়া নিশ্চিন্তবাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সড়কে নুনদহ ঘাট পর্যন্ত করতোয়া নদীর উপর সেতু নির্মাণের জন্য ২৬ কোটি ৮২ লাখ ৩৩ হাজার ৮৭৮ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে পীরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী মশিউর মজিবর রহমান জানান, ২০১৯ সালে সেতুটির পিলার ক্যাপের কাজ হয়। ওই সময়ে করা ৫ নম্বর পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। এ ঘটনা দেখতে গত ৩০ এপ্রিল ঢাকা থেকে এলজিইডির ৩ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত টিম ঘটনা তদন্ত করতে আসে। টিমের সঙ্গে রংপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান আলীও ছিলেন। তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় কয়েক বছর ধরে কাজটি বন্ধ রয়েছে। এছাড়া সেতুটির জন্য ৫ একর ৩৩ শতাংশ জমি এখনো অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি। কাজ করতে গিয়ে বারবার জমির মালিকদের কাছ থেকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
আলী জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে রংপুরের এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান জানান,জেলা প্রকৌশল বিভাগের অনুমোদন ও ঢাকার প্রধান প্রকৌশল দপ্তরের অনুমোদনপত্র নিয়ে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট পীরগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। জেলা ভূমি কার্যালয় থেকে অনুমোদন এলেই জমির মালিকরা জমি অধিগ্রহণের টাকা পাবে এবং সেতুর নির্মাণ কাজেরও গতি বাড়বে। গত ৩০ এপ্রিল ঢাকা থেকে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত দল সেতু পরিদর্শন করেছে । তদন্ত করতে আসা প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা প্রতিবেদন দেওয়ার পর ঢাকা থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, রংপুরের মিঠাপুকুর ও পীরগঞ্জ এবং দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গেছে করতোয়া নদী। আর এই নদীর কারণে প্রতি বছর বন্যায় ভেঙে গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় অসংখ্য গ্রাম করতোয়ার গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এ জন্য দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটের সিংড়া ইউনিয়নের মারনুপাড়া এবং পীরগঞ্জের চতরা ইউনিয়নের গিলাবাড়ী করতোয়া নদীর নুনদহ ঘাটে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। আর এই সেতুটি নির্মিত হলে পীরগঞ্জের সঙ্গে ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ ও বিরামপুর উপজেলাসহ হিলি, জয়পুরহাট এবং বিন্দগঞ্জ-বিরামপুর-ফুলবাড়ী-দিনাজপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের সঙ্গে যোগাযোগও সহজ হবে।
এসআইএইচ