মাঘের শীতে কাবু রংপুরের ৮ জেলা
মাঘের শীতে কাবু হয়ে পড়েছে রংপুর বিভাগের আট জেলার নিম্ন আয়ের মানুষেরা। দিনপঞ্জিকায় এখন চলছে মাঘ মাস। এই মাসে শীতের তীব্রতা আরও বাড়বে এমন আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। আজ বৃহস্পতিবার রংপুরে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে রংপুর অঞ্চলে চলছে হালকা ও মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ। সঙ্গে রয়েছে হিমেল বাতাসের কনকনে শীত। শীতের তীব্রতার সঙ্গে শৈত্যপ্রবাহের প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এখানকার জনজীবন। কয়েকদিন ধরে সূর্যের দেখা মিললেও ভোর বেলা উত্তরের আকাশে বিরাজ করছে ঘন কুয়াশা আবার দুপুরের পরে কোথাও কোথাও শীতের দাপটে সূর্যের দেখা মিলছে না। এমন জুবুথুবু শীতে বাড়ছে রোগ, সঙ্গে আগুন পোহাতে গিয়ে ঘটছে দগ্ধ হওয়ার ঘটনা। মাঘের মাঝামাঝি শীতের তীব্রতা আরও বাড়ার আশঙ্কায় শঙ্কিত এখানকার নিম্ন আয়ের ও দরিদ্র মানুষেরা। বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র না থাকায় দুর্ভোগও বেড়েছে। বিভাগের নদী তীরবর্তী ও ছিন্নমূল মানুষেরা পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। যেন তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে শীতের প্রভাব।
বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন ছিন্নমূল আর গ্রামীণ মানুষেরা। শীতের পাশাপাশি কুয়াশা বেশি হওয়ায় সড়কে হেডলাইট জ্বালিয়ে চলছে গাড়ি। এতে ধীর গতিতে চলছে দূরপাল্লার পরিবহন। এদিকে তীব্র শীতে ইরি-বোরোর চারা রোপন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষকরা। কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না আবার যাদের পাওয়া যাচ্ছে তাদের দিতে হচ্ছে বেশি টাকা মজুরি। এর ফলে সার, বীজ ও সেচের সঙ্গে কৃষি শ্রমিকের মজুরিতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। বিশেষ করে রংপুরে তিস্তা, ঘাঘট, করতোয়া, যমুনেশ্বরী বিধৌত চরাঞ্চলে বসবাসকারী হাজার হাজার পরিবার শীতে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। তাদের বেশিরভাগ মানুষের কাছে এখনো শীতবস্ত্র পৌঁছেনি।
রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তা নদীর ঢুষমারা চরের কাচামাল বিক্রেতা নজরুল জানান, তীব্র শীতের কারণে বিক্রি অনেক কমে গেছে। হাড় কাঁপানো শীতে জীবিকার প্রয়োজনে দোকান খুলে বসে থাকলেও তাতে তেমন লাভ হচ্ছে না।
নগরীর কামারপাড়া এলাকার গৃহিণী মিতু বেগম জানান, সাতসকালে উঠেই সন্তানদের স্কুলে রেখে আসতে হয়। কয়েক দিন ধরে ঠান্ডায় তার ছোট মেয়ে ও তিনি সর্দি-কাশিতে ভুগছেন। এমনকি চিকিৎসার জন্য এর মধ্যে সদর হাসপাতালেও গিয়েছিলেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, এমন পরিস্থিতিতে বেড়েছে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগের প্রকোপ। তীব্র শীতে কয়েক দিনের তুলনায় হাসপাতাল গুলোতে রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ বিষয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের রেজিস্ট্রার ডা. তানভীর চৌধুরী বলেন, শীতজনিত রোগ বালাই বিশেষ করে নিউমোনিয়া, কোল্ড ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আক্রান্তদের বেশিরভাগই শিশু ও বয়স্ক মানুষ। শীতজনিত রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত প্রায় সহস্রাধিক শিশু গত ৭-৮ দিনে ভর্তি হয়েছে। শিশুরা কোল্ড ডায়রিয়ায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে।
রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান জানান, শীতে অসুস্থ নারী, পুরুষ ও শিশুদের জরুরি চিকিৎসার জন্য রংপুর বিভাগের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য কর্মীরা কাজ করছে। জরুরি সেবা দিতে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মেডিকেল টিম রয়েছে। পুরো বিভাগে ৫৪৪টি টিম শীতকালীন রোগে আক্রান্ত শিশু, নারী ও বয়স্কদের সেবা প্রদান করছে। একটি বিভাগীয় মনিটরিং টিম রয়েছে।
জানা গেছে, রংপুর জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৩০ লাখ। এর মধ্যে শীতার্ত মানুষের সংখ্যা পাঁচ লাখেরও বেশি। তার মধ্যে শুধুমাত্র রংপুর মহানগরীতে বাস করে প্রায় ৭০ হাজার ভাসমান নারী-পুরুষ। এরা রেল স্টেশনের প্ল্যাটফরম, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতের বারান্দা আর ফুটপাতে রাত কাটায়। জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। একইভাবে জেলার আট উপজেলা বিশেষ করে তিস্তা, ঘাঘট, করতোয়া, যমুনেশ্বরী বিধৌত চরাঞ্চলে বসবাসকারী হাজার হাজার পরিবার শীতে মানবেতর দিন কাটাচ্ছে। তাদের বেশিরভাগ মানুষের কাছে এখনো শীতবস্ত্র পৌঁছেনি।
এ প্রসঙ্গে রংপুর জেলা প্রশাসক ড. চিএলেখা নাজনিন জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৫৯ হাজার কম্বল বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এসব কম্বল রংপুরের আট উপজেলায় ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আরও শীতবস্ত্র চাওয়া হয়েছে। দুই-চার দিনের মধ্যে ৩০ হাজার পিস কম্বল এসে পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
রংপুর আবহাওয়া অফিস জানায়, বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) রংপুরে ৯ দশমিক ৪ ডিগ্রী, সৈয়দপুরে ৭ দশমিক ৮ ডিগ্রী, ডিমলায় ৯ দশমিক ৫ ডিগ্রী, রাজারহাটে ৮ ডিগ্রী ও তেতুলিয়ায় ৬ দশমিক ৮ ডিগ্রী সেলিসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
এর আগে রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বুধবার (১৮ জানুয়ারি) রংপুরে সর্বনিম্ন ৮ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এ ছাড়াও তেঁতুলিয়ায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৬ দশমিক ২, দিনাজপুরে ৭ দশমিক ৪, ডিমলা ও রাজারহাটে ৭ দশমিক ৮ এবং সৈয়দপুরে ৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, চলতি সপ্তাহে রংপুর বিভাগে তাপমাত্রা এত নিচে নামেনি। এ অবস্থা আরও দুই থেকে তিন দিন অব্যাহত থাকতে পারে।
এসআইএইচ