বাঁশি বাজিয়ে ভাত জোটে প্রতিবন্ধী রাজকুমারের
বুকে ঝুলিয়েছেন একটি লেমেনেটিং করা কাগজ। সেই কাগজে লেখা ‘আমি অন্ধ রাজকুমার, বাঁশি বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি, আমাকে সাহায্য করুন’। তার এই প্রার্থনা ও বাঁশির মূর্ছনায় মুগ্ধ মানুষের কাছ থেকে যা পান, তাই জীবিকার অংশ হিসেবে দাঁড়ায় প্রতিবন্ধী রাজকুমারের জন্য। প্রায় ৪১ বছর ধরে নগরীর রাস্তাঘাটে আনাচে-কানাচে বাশেঁর বাশির সুরে জাতীয় সঙ্গিত ও বিভিন্ন কালজয়ী গানের সুরের মূর্ছনায় বাঁশি বাজিয়ে পথ চলছেন তিনি। এই বাঁশি বাজিয়ে সুরে আকৃষ্ট করে যাচ্ছেন কিশোর-তরুণ-যুবক বয়স্কদের। বংশীবাদক রাজকুমারকে রংপুর নগরীর বেশির ভাগ মানুষই চেনেন হ্যামিলোনের বাঁশিওয়ালা নামে।
সম্প্রতি রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হয় রংপুর নগরের স্টেশন রোড এলাকায়। অন্ধ এই বংশীবাদক আপন মনে বাঁশি বাজিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন। আর তার করুণ সুরের বাঁশির মূর্ছনায় থমকে দাঁড়ান অনেক পথিক। কেউ আবার রাজকুমারের কণ্ঠে গানও শুনেন। বাঁশির সুর আর গানে কারও মন ভরলে রাজকুমারের হাতে জোটে জ্বালা নিবারণের বকশিস।
সপ্তাহে দুই দিন বাড়িতে থাকেন রাজকুমার। বাকি দিনগুলো নগরীর পাড়া-মহল্লার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত বাশিঁ বাজিয়ে ছুটে চলেন তিনি। দৃষ্টিহীন হলেও রাজকুমার রংপুরের পথঘাট সম্পর্কে সব ভালোই জানেন।
সপ্তাহে পাঁচ দিন বংশীবাদক রাজকুমার নগরের বাস টার্মিনাল, কামারপাড়া কোচ স্ট্যান্ড, ধাপ মেডিকেল মোড়, লালকুঠি মোড়, সেন্ট্রাল রোড, লালবাগ, মুন্সিপাড়া, জুম্মাপাড়া, সুপার মার্কেট, কাচারীবাজারসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজিয়ে মানুষকে বাশির সুরে দোলা দিয়ে যান বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের। তিনি বাঁশি বাজিয়ে মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে ছুটে বেড়ান। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো বাঁশির সুরের বিনিময়ে দিন শেষে তার পকেটে ভরে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। আবার কোনো কোনো দিন ২৫০ থেকে ৪০০ টাকাও বকশিস জোটে তার বাঁশির সুরে। যা উপার্জন হয় তা দিয়ে সংসার, নয়তো নিজের প্রয়োজন মেটান রাজকুমার।
বংশীবাদক রাজকুমারের বয়স ৫৮ বছর। বিয়ে করেননি। দুই চোখে দেখতে পারেন না বলে চলার সঙ্গী তার লাঠি। তার বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে যে যা পারেন তাকে দান করেন। আর এতে তার জোটে পেটের খাবার। এভাবেই ৪১ বছর ধরে চলছে তার দিনের পরদিন। প্রমিত উচ্চারণে সব সময় কথা বলেন রাজকুমার।
রাজকুমারের বাড়ি রংপুর শহরের রামপুরা এলাকার ডাক্তারপাড়ায়। ছয় বছর বয়সে বাবা ব্রজেন রায় এবং পরের বছর মা মারা যান। বিয়ের কথা এবং পরিবারে কারা আছেন জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘থাক ওসব কথা।’ বললেন,এখন আমি আমাকে নিয়ে আছি। বাঁশির সুরে জীবন চলছে আমার।
দুই চোখ নষ্ট হওয়ার ঘটনা জানতে চাইলে রাজকুমার কাঁপা কাঁপা স্বরে বলেন, ‘১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় আমি তখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। ওই সময় গোলাবারুদের গ্যাসে চোখ অনবরত চুলকাতে চুলকাতে লাল হয়ে যায়। ওষুধ দিয়েও ভালো হয় না। এরপর আস্তে আস্তে দুই চোখে কম দেখতে থাকি। এক সময় আর দেখতে পারি না। এ কথা বলতে গিয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ থেমে বাঁশিতে ভাওয়াইয়া গানের সুর তোলেন, ‘ও মোর বানিয়া বন্ধুরে একটা কবজ বানাইয়াদে।’
বংশীবাদক রাজকুমার বলেন, বাঁশি শুনে যে যার মতো আর্থিক সাহায্য করেন। এতে যে খুব বেশি টাকা উপার্জন হয় তাও নয়। দুই বেলা খাবারের জন্য আমার এই ছুটে চলা। বাঁশিতে নানান গানের সুর তোলে পথচারীদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন। কখনো এক বেলা, আবার কখনো এরও কম সময় বাঁশিতে সুর তোলেন। কেননা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এভাবে বাঁশি বাজানোও খুব কষ্টের ব্যাপার। আবার প্রতিদিনও যে সম্ভব, তাও নয়। বাঁশির সুর তোলা শরীর-মনের উপর নির্ভর করে।
গতকাল বুধবার (১৯ অক্টোবর) বিকালে নগরীর কেরামতিয়া স্কুল মোড়ে বাঁশিতে সুর তুলে গান গাওয়ার এক ফাঁকে এসব কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন রাজকুমার। তার শখ ছিল বাঁশি বাজানো। তাই ছোটবেলা থেকে বাঁশিতে সুর তুলতেন। দুই চোখ দিয়ে কিছু দেখতে না পেলেও বাঁশির সুরে লোকজনের মন জয় করে চলেছেন।
এসআইএইচ