যোগাযোগ-বিদ্যুৎ সুবিধা চান নয়ারহাট বস্ত্রপল্লির উদ্যোক্তারা
হেমন্তের শুরুতেই শীতের আমেজ চলে এসেছে দেশের বেশ কিছু এলাকায়। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। উত্তরের গ্রামীণ জনপদে গড়ে ওঠা কুটির শিল্প এলাকায়ও শুরু হয়েছে শীতের পোশাক তৈরির ব্যস্ততা। জমজমাট না হলে শুরু হয়েছে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার নয়ারহাটের শীতবস্ত্র বেচাকেনা।
বিদ্যুৎ, যোগাযোগ, টেলিফোন বা মোবাইল ও প্রযুক্তিগত সুবিধাবঞ্চিত এ জনপদের প্রত্যয়ী মানুষের নিজস্ব প্রচেষ্টায় গড়ে উঠে শীতবস্ত্রের এ বাজার। করোনা মহামারির দুই বছরের লোকসান কাটাতে এ মৌসুমে নবোদ্যমে উৎপাদন ও বিক্রির জন্য প্রস্তুত গোবিন্দগঞ্জের হোসিয়ারিপল্লি কোচাশহরের নয়ারহাট।
এক সময়ের মঙ্গাপীড়িত উত্তরাঞ্চলের জনপদটি এখন কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের উজ্জ্বলতম উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এবারের শীতকে সামনে রেখে দেশের সর্বমোট চাহিদার এক তৃতীয়াংশ শীতবস্ত্র উৎপাদনকারী এ এলাকার ব্যবসায়ীরা চলতি বছর রেকর্ড পরিমাণ বিক্রির স্বপ্ন দেখছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে বিগত দুই বছর উৎপাদন ও বিপণনে সৃষ্ট সমস্যা কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি শীত মৌসুমে এখানে উৎপাদিত শীতবস্ত্র বিক্রি পাঁচশ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন তারা। গত এক মাস ধরে দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে আসা শত শত ছোট-বড় ব্যবসায়ী এখান থেকে কিনতে শুরু করেছেন নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্র। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলা এ শীতবস্ত্রের বাজারে নিরাপদে কেনাকাটা হয়। ট্রাক-বাস-পিকআপ-ট্রেনসহ বিভিন্ন যানবাহনযোগে এসব মালামাল নিয়ে ব্যবসায়ীরা ছড়িয়ে পড়ছেন সারা দেশে।
এখানকার উদ্যোক্তরা জানান, বর্তমানে দেশের চাহিদার একতৃতীয়াংশ শীতবস্ত্রের যোগান দেন কোচাশহরের নয়ারহাট কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প মালিক ও ব্যবসায়ীরা। কোচাশহর ইউনিয়নের পেপুলিয়া, বনগ্রাম, কানাইপাড়া, ধারাইকান্দি, রতনপুর, শক্তিপুর, ছয়ঘরিয়া, আরজী শাহাপুর, পার্শ্ববর্তী মহিমাগঞ্জ, পুনতাইড়, কুমিড়াডাঙ্গা, গোপালপুর, শিবপুর, কামারদহ গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিয়ে এটি গড়ে উঠেছে।
এ ছাড়া বগুড়া জেলার সৈয়দপুর, সোনাতলা, বালুয়াহাটসহ চারিদিকের অর্ধশতাধিক গ্রামে গড়ে ওঠা শীতবস্ত্র তৈরির ছোটবড় কারখানায় প্রতি বছর উৎপাদিত হচ্ছে আড়াই থেকে তিনশ’ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকার শীতবস্ত্র। বর্তমানে কোচাশহর, গোবিন্দগঞ্জ, ধারাইকান্দি, রতনপুরসহ আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় এখানকার উৎপাদিত শীতবস্ত্র বিক্রির বেশ কয়েকটি ছোট ছোট বাজার গড়ে উঠেছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ছোট বড় দুই শতাধিক দোকানে এখন চলছে পুরোদমে বেচাকেনা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকাররা ঘুরে ঘুরে কিনছেন তাদের প্রয়োজনীয় নানা শীতবস্ত্র। কথা হলো রাজশাহীর গোদাগাড়ীর ব্যবসায়ী আবু হেনার সঙ্গে। তিনি জানালেন, কমদামে উন্নতমানের শীতবস্ত্র কিনতে তিনি প্রতি বছরই এখানে আসেন।
ফরিদপুরের ব্যবসায়ী সুশীল দেবনাথ বললেন, রাস্তার বেহালদশার কষ্ট ভুলিয়ে দেয় এখানকার ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা ও আতিথেয়তা।
সিলেটের শ্রীমঙ্গল থেকে আসা কাপড় ব্যবসায়ী রুবেল আহমেদ, কুড়িগ্রামের আব্দুর রউফ ও জামাল উদ্দিন জানালেন, দিন বা রাতের যেকোনো সময় এখানে টাকা পয়সা নিয়ে নিরাপদে চলাচলের নিশ্চয়তা খুব বড় স্বস্তির।
নয়ারহাট হোসিয়ারি শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান সরকার অভিযোগ করলেন, বছরের পর বছর সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিয়েও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সদরে যাতায়াতের জন্য কোচাশহর পর্যন্ত রাস্তাটি মেরামত করানো সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া বিদ্যুত সমস্যার পাশাপাশি কোনো মোবাইল ফোনের টাওয়ার না থাকায় চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের। রাস্তার কারণে বড় গাড়ি এখানে আসতে না পারায় মালামাল ভ্যান বা ছোট পিকআপে করে কোচাশহরে নিতে দ্বিগুণ খরচ এবং চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
নয়ারহাটের শীতবস্ত্র প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা তিন বোন হোসিয়ারির মালিক মশিউর রহমান জানান, এখানে কোনো ব্যাংক না থাকায় টাকা লেনদেন এবং ঋণ সুবিধাবঞ্চিত হয়ে আছেন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ক্ষুদ্র মালিকরা বিভিন্ন এনজিও ও দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন।
নয়ারহাট বাজারের স্বপ্নছোঁয়া বোতাম ও সেলাইঘরের মালিক ইউসুফ আলী বলেন, সারা বছর ধরে উৎপাদিত শীতবস্ত্র সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। চলতি বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় তীব্র শীত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই এবার ব্যবসাও ভালো হবে বলে আশা করছেন তারা।
কোচাশহরের মানুষের উদ্যোগে গড়ে তোলা কুটিরশিল্পকে সরকারি স্বীকৃতির পাশাপাশি অবিলম্বে এখানকার প্রয়োজনীয় রাস্তাগুলি সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল লতিফ প্রধান।
এসএন