ডিম সিন্ডিকেটে অসহায় উৎপাদক-ভোক্তা
প্রায় ২০ কোটি ডিমের উদ্বৃত্তের রাজশাহীতে সিন্ডিকেটের কাছে দাম নিয়ে অসহায় ভোক্তাসহ উৎপাদনকারীরা। ডিম ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ ছাড়া কার্যকর কোন সামাধান মিলছে না। এমন পরিস্থিতিতে উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের দাবি সু-সমন্বিত মূল্য নির্ধারণ করে বাজারকে স্বাভাবিক রাখা।
সর্বশেষ শনিবার (১১ মার্চ) রাজশাহীর সাহেব বাজারের খুচরা লাল ডিম বিক্রি হয়েছে প্রতিহালি ৪২ টাকা ও সাদা ডিম ৪০ টাকা দরে। কেউ কেউ ৪৪ টাকা হালি দরেও ডিম বিক্রি করছেন। আর পাইকারিতে প্রতি ১০০টি ডিমের দাম ৯৭০ টাকা থেকে ৯২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। সেই হিসেবে একটা ডিমের (লাল) দাম পড়ছে ৯ টাকা ৭০ পয়সা। আর সাদা ডিম বিক্রি হয়েছে ৯ টাকা ২০ পয়সায়। একইদিন খামারিরা ব্যবসায়ীদের কাছে ডিম বিক্রি করেছে ৮ টাকা থেকে ৮ টাকা ৮০ পয়সায়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, খামারির উৎপাদিত ডিমের দাম নির্ধারণ করেন ব্যবসায়ীরা। উৎপাদনের পরে চার থেকে পাঁচ হাত ঘুরে ভোক্তার কাছে পৌঁছায় ডিম। আর প্রতি হাতবদলে ডিমের দাম বাড়ে ২০ থেকে ৫০ পয়সাসহ কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি। অথচ একজন খামারি প্রতিটি ডিমে ২০ থেকে ২৫ পায়সার বেশি লাভ করতে পারেন না। মধ্যসত্ত্ব ভোগীরাই কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সুবিধা লুটছে। অথচ কার্যকর কোন নজরদারি নেই প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিন ডিমের দাম থেকে শুরু করে বাজার নিয়ন্ত্রণের কাজগুলো সম্পাদন করা হয় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। ব্যবসায়ীরা পাবনা, ঢাকা ছাড়াও দেশের বড় বড় বাজারে যোগাযোগ করে ডিমের দাম নির্ধারণ করেন। সেই সব বাজারগুলোর ডিমের দামের উপরে নির্ভর করে রাজশাহীর ডিমের দাম।
পবার কুখুন্ডি মল্লিকপুর এলাকার লেয়ার মুরগির খামারি জামরুল ইসলাম জানান, তার খামারে ৯৩০ টা লেয়ার মুরগি রয়েছে। এই মুরগি ১৮ থেকে ২২ মাস পর্যন্ত ডিম দেবে। নতুন মুরগির প্রথম ৬ মাস ডিম আসে ৯০ শতাংশ। পরের ১০ মাসের বেলায় ডিমের উৎপাদন দাঁড়ায় ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। ১৫ মাসের বেলায় ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ডিম পাওয়া যায় খামার থেকে। তবে এসময় ডিমের বাজার ভালো থাকতে হবে। অন্যথায় বেশি দামে খাবার খাওয়ানোর ফলে ডিম বিক্রি করে লাভ থাকবে না।
এই মুরগিগুলোর প্রতিদিন দুই বস্তা খাবার লাগে। যার ওজন ১০০ কেজি। দুই বস্তা (কোয়ালিটি প্রিমিয়ার) খাবারের দাম ৬ হাজার ৬০ টাকা। নতুন মুরগি হিসেবে প্রতিদিন ৮৩০ টা করে ডিম দেয়। একটি ডিমে খরচ পড়ে সাত টাকার উপরে। বিক্রি হচ্ছে ৮৭০ থেকে ৮৮০ টাকা (রোববার ৫ মার্চের দাম)। একটি ডিম বিক্রি করে কমবেশি এক টাকা থাকে। তবে বিদ্যুৎ বিল, ওষুধ, নিজের মজুরি ছাড়াও অন্য খরচ বাদ দিলে নগণ্য কিছু লাভ থাকে।
খামারিদের দাবি, ডিমের দাম নির্ধারণে খামারির কোন হাত থাকে না। এটা আড়তগুলো থেকে নির্ধারণ হয়। অনেক সময়ই উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামেও ডিম বিক্রি করা লাগে। ডিম বিক্রির একটা সিন্ডিকেট আছে। আর গত ১৮ থেকে ২০ দিন আগে ডিমের দাম ছিলো ৯ টাকা ৮০ থেকে ৯০ পয়সা। এই দাম ১৫ দিনও থাকে নি। তার পরে কমে গেছে। ডিমের দাম উঠা-নামা করে। কিন্তু খাবারের দাম বাড়লে আর কমে না।
কোম্পানিগুলোর খাবারের দাম বাড়ানো বিষয়ে খামারি জামরুল ইসলাম বলেন, আমি ৮ বছর থেকে এই ব্যবসার সাথে জড়িত। ৮ বছর আগে ৫০ কেজি খাবারের বস্তার দাম ছিল ১৫০০ থেকে ১৫৫০ টাকা। ওই বস্তা এখন ৩ হাজার ৩০ টাকা। তাহলে ৮ বছরে প্রতি বস্তায় বেড়েছে প্রায় ১৫০০ টাকা। কিন্তু আট বছর আগে ডিম বিক্রি করেছে ৮ টাকা থেকে সাড়ে ৮ টাকায়। এখনও প্রায় ওই দামেই ডিম বিক্রি করছি।
খাবারের দাম বাড়ার এক সপ্তাহ আগে মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ দেবে। কিংবা ডিলারের জানিয়ে দেবে ফিডের দাম বাড়ার তারিখ। গত সপ্তায় এক বস্তা খাবারে বেড়েছে ৭৫ টাকা। গত বছর (২০২২) চারবার দাম বেড়েছে খাবারের দাম। নতুন বছর পরে এক বারে ৭৫ টাকা খাবারের দাম বেড়েছে। ব্যবসা শুরু সময়ে একটা মুরগির বাচ্চা দাম ছিল ৩০ থেকে ৫৫ টাকার মধ্যে। এখনও সেই দাম আছে। মুরগির বাচ্চার দাম বাড়ে নি।
সাদেকুল ইসলাম নামের আরেক লেয়ার মুরগির খামারি জানান, ডিম উৎপাদন করে আর আগের মতো লাভ হয় না। যে টাকা লাভ হয় খাবার কিনতেই শেষ হয়ে যায়। খামারে ১ হাজার লেয়ার মুরগি তুলে ছিলাম। এখন টিকে আসা ৯২০ টা। এই মুরগিগুলো ঠিক মতো ডিম দিক আর না দিক খাবার দিতে হবেই। খাবার দিতে না পাড়লে উৎপাদন যতটুকু আছে, তাও থাকবে না।
তিনি আরও জানান, লেয়ার মুরগির খামার করেছিলাম ঋণ করে। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি আছে। যে ডিম উৎপাদন হয় তা দিয়ে নিজের সংসার ও কিস্তি চালাই। তবে খাবারের দাম অনুযায়ী ডিমের দাম আরো ২ টাকা বাড়লে ভালো হতো। আমরা ডিম বিক্রি করছি ৮ টাকা, সাড়ে ৮ টাকা, সর্বোচ্চ ৮ টাকা ৮০ পায়সা। অথচ বাজারে খুচরা বিক্রি হচ্ছে ১১ থেকে ১২ টাকায়। তার দাবি, বাজার পর্যায়ে না; খামারি পর্যায়ে ডিমের দাম বাড়লে আমরা বাঁচতাম।
ডিম ব্যবসায়ী সেন্টু জানান, প্রতিদিন স্থানীয় বাজারের দাম বেলা ১২টার পরে নির্ধারণ করা হয়। রাজশাহীতে সবচেয়ে বেশি ডিম উৎপাদন করে নাবিল গ্রুপ। গতকাল শনিবার (৪ মার্চ) নাবিল গ্রæপের নাবা ফার্ম লিমিটেডের ডিম বিক্রয় কেন্দ্রে প্রতি ১০০টি লাল ডিম বিক্রি হয়েছে ৯২০ টাকায়। এছাড়া স্থানীয় বাজারে ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয়ে থাকে বিভাগের পাবনা, ঢাকার বিভিন্ন বাজারের ডিমের দাম শুনে।
ডিমের বাজারের বিষয়ে রাজশাহীর সাহেব বাজারের খুচরা ডিম বিক্রিতা মোস্তাফিজুর রহমান জানান, শনিবার (৪ মার্চ) তুলনায় রোববার (৫ মার্চ) প্রতি একটি ডিমের দাম বেড়েছে ১০ পয়াসা। এছাড়া বাজারে খুচরা লাল ডিম প্রতিহালি ৪২ টাকা ও সাদা ডিম ৪০ টাকা হালি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পাইকারিতে প্রতি ১০০টি ডিমের দাম ৯৭০ টাকা ও সাদা ডিম ৯২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের দাম নির্ধারণ কারা করে ও ডিমের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ছোট ব্যবসায়ী। আর আমার ব্যাবসার বয়স বেশি দিন না। তাই আমি বলতে পারছি না।
রাজশাহী প্রাণী সম্পদ দপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় ২ হাজার ১২টি খামারে প্রতিমাসে পৌনে ৫ কোটি ডিম উৎপাদন হয়। আর ডিমের বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৫৭ কোটি। অথচ রাজশাহীতে ডিমের চাহিদা মাত্র ৩৭ কোটি। উদ্বৃত্তের রাজশাহীতেও ডিম কিনতে গিয়ে দিশেহারা ক্রেতারা।
খুচরা ক্রেতা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ডিমের দাম একেক জায়গায় একেক রকম। হালি হিসেবে ডিম নিলে এক থেকে দেড় টাকা কম পাওয়া যায়। আর খুচরা নিলে বেড়ে যায় ডিমের দাম। সাহেব বাজারের খুচরা দোকানের তুলনায় এলাকার দোকানগুলো প্রতি হালিতে দুই থেকে আড়ায় টাকা বেশি।
রাজশাহী পোল্টি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, সাধারণ ভোক্তারা ৪০ থেকে ৪৫ টাকা হালি দরে ডিম কেনে। একটা ডিম সাধারণ মানুষ ১১ থেকে ১৩ টাকায় কিনছে। এই যে এতো টাকা গ্যাপ হয়ে গেলো। এই গ্যাপের পেছনে কারণ হলো মধ্যসত্ত্ব ভোগি। সরাসরি বিক্রেতার কাছে যাচ্ছে। কয়েক ধাপ পেড়িয়ে ক্রেতার হাতে পরে। কোম্পানিগুলো বড় বড় সেড করছে, তারাই বিভিন্ন বাচ্চা লালন-পালন করে বাজারে দিচ্ছে। তাদের সাথে তো ছোট ছোট খামারিরা পেরে উঠবে না। কোম্পানিগুলোর কাছে ছোট ছোট খামারীরা জিম্মি হয়ে পড়েছে। বড় বড় কোম্পানিগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে।
রাজশাহী জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, আমাদের দেশে ডিমের দাম ওইভাবে নির্ধারণ হয়। ডিমের দাম বেঁধে দেওয়া হয় না। খাদ্য খরচ বাড়লে ডিমের দাম বাড়ে। খামারিদের কথা ডিমের দাম আরও বাড়ানো হোক। ডিমের বাজারে ফরিয়া বা মিডিলম্যান (মধ্যসত্বভোগীদের) যে দৌরাত্ম্য তো আছেই। শুধু ডিমেই নয়, সবজি, মাছ সবক্ষেত্রেই এই দৌরাত্ম্য। এছাড়া করপোরেট বিভিন্ন কোম্পানির কাছেও প্রায়শই জিম্মি দশা তৈরি হয়। এখন এটা পলিসিগত বিষয়। রুট লেভেলে কাজ করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না।
এএজেড