রাজশাহীতে থামেনি নিপাহ ভাইরাসের চোখ রাঙানি
সংক্রমিত নিপা ভাইরাসের চোখ রাঙানি রাজশাহীতে থামেনি। চলতি মাসেই নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি মৌসুমে এই ভাইরাসটি রাজশাহীতে ধরা পড়ার পর মোট চারজনের প্রাণহানি হয়েছে। রোগী বাড়তে থাকায় এই হাসপাতালে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আজিজুল হককে তত্ত্বাবধায়ক করে একটি বিশেষ টিম গঠন করে তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তবে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনদের উদাসীনতায় সংক্রমণ বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ তারা অনিয়ন্ত্রিতভাবেই চলাফেরা করছেন।
হাসপাতালের তথ্য বলছে, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ১৮ বছর বয়সী লিটল আলী নামক এক কিশোরের মৃত্যু হয়। তার বাড়ি নওগাঁ জেলার মহাদেবপুরে। আরেকজন রঞ্জু সরকার (৪৫)। তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর। এর আগে গত ২৪ জানুয়ারি মো. সোয়াদ (৭) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। সে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মো. সানোয়ারের ছেলে। এর কিছুদিন আগে গোদাগাড়ি উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের এক নারী রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নিপা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
এ ছাড়াও সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে হাসপাতালের অন্য ওয়ার্ড থেকে নিপাহ ভাইরাস ওয়ার্ডে ভর্তির পূর্ব মুর্হূতে এক ৯০ বছর বয়সী বৃদ্ধার মৃত্যু হয়। লক্ষণ দেখে ধারণা করা হচ্ছিল তিনিও নিপাহ ভাইরাসে মারা গেছেন। তার নমুনা ঢাকায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) পাঠানো হয়। তবে পরে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। আর মৃতদের প্রত্যেকের শীতের মধ্যে খেজুরের রস পানের ইতিহাস রয়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা।
শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে ৩০ নম্বর নিপাহ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, দুইটি রুমের একটিতে নিপাহ সাসপেক্টেড ও অপরটিতে নিপাহ পজেটিভ রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হাসপাতালে বর্তমানে নিপাহ পজেটিভ রোগী নেই। তবে নিপাহ সাসপেক্টেড রোগী আছেন চারজন। এরা হলেন-কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বাসিন্দা চন্দনা (১৫), দুর্গাপুরের বাসিন্দা আকলিমা বেগম (৩৭), চারঘাটের বাসিন্দা সাহারা (৪০) এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ কানসাটের বাসিন্দা আবু সালেহ (২০)। চিকিৎসাধীন প্রত্যেকেই খেজুরের রস পান করেছেন বলে জানা যায়।
এদিকে নিপাহ ভাইরাস ও করোনার মতো সংক্রমণের শঙ্কার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু এ বিষয়ে উদাসীন চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনরা। নিপাহ ভাইরাস সাসপেক্টেড ওয়ার্ডে থেকেও ন্যূনতম মাস্ক ব্যবহারে স্বজনদের উদাসীনতা দেখা গেছে। এছাড়া এই ওয়ার্ডের ভেতরে-বাইরে ইচেছ মতো অনিয়ন্ত্রিতভাবেই চলাফেরা করছেন তারা, যা এই ভাইরাসকে সংক্রমিত করতে পারে।
চিকিৎসাধীন এক রোগীর স্বজন আজিজা বেগম জানান, তার রোগীর নিপাহ ভাইরাস নাই। তবে লক্ষণ আছে। এ ছাড়া খেজুরের রসও পান করেছিল। আর মাস্ক নেই, কারণ এই ভাইরাস সম্পর্কে সেভাবে জানেন না। তবে ডাক্তার-নার্স যখন বলেন, তখন মাস্ক ব্যবহার করেন।
নিপাহ রোগী ব্যবস্থাপনায় ৭ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষায়িত টিমের টিম লিডার ডা. আবু ইউসুফ জানান, ২ ফেব্রুয়ারি থেকে নিপাহ ভাইরাস রোগী ও সাসপেক্টেডদের জন্য বিশেষায়িত ব্যবস্থাপনা নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এর আগে অন্য একটি রুমে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। এখানে রোগীদের জন্য আইসিইউসহ সব ব্যবস্থাই আছে।
তিনি আরও জানান, এখানে এখন নিপাহ পজেটিভ রোগী নেই। আর সাসপেক্টেড ওয়ার্ডে প্রাথমিক কিছু লক্ষণ যেমন: ব্রেন ইনফেকশন, খিঁচুনি, অজ্ঞাত হয়ে যাওয়া, জ্বরের রোগীরা আছেন। তাদের নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল। রোগীদের কারও নিপাহ পজেটিভ আসেনি। কিন্তু লক্ষণগুলো আছে। সেই অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর যেহেতু নিপাহ ভাইরাস মানুষের শরীর থেকে সংক্রমণের শঙ্কা রয়েছে। সুতরাং রোগীদের স্বজনদের সেইভাবে সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে বিষয়ে রামেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহাম্মদ জানান, তিনি হাসপাতালে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই যেহেতু রোগী বাড়ছিল, তাই বিশেষায়িত ব্যবস্থা নেন। নিপাহ রোগীদের নিয়মিতই তদারকি করছেন। এখন পর্যন্ত ৪ জন রোগী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তবে পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
উল্লেখ্য, আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী দেশে ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ ভাইরাস রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ২০০৩ সালে শনাক্ত হয় নওগাঁয়। তবে সবচেয়ে বড় আকারের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ফরিদপুর জেলায় ২০০৪ সালে। সেই বছর ফরিদপুরে নিপাহ ভাইরাসে ৩৫ জন আক্রান্ত হন। এর মধ্যে ২৭ জনেরই মৃত্যু হয়। দেশে গত ২০ বছরে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ৭১ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে। সংক্রমণ রোধে খেজুরের রস পানে নিষেধসহ সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে আইইডিসিআর।
এসআইএইচ