সুনামগঞ্জে নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়নি ফসলরক্ষা বাঁধ
হাওর-অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ জেলায় প্রবল বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে দেখা দেয় অকাল বন্যা। মার্চের দিকে শুরু হওয়া এই বন্যায় হাওরের বোরো ধান ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে ধান রক্ষায় প্রতি বছর সুনামগঞ্জ জেলায় হাওরে নির্মাণ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধ।
কিন্তু এ বছরে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাওরের বাঁধ নির্মাণ কাজ শতভাগ শেষ করার কথা থাকলেও সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় বেশিরভাগ বাঁধের কাজ এখনও শেষ হয়নি। একইসাথে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে স্বেচ্ছাচারিতার অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
যদিও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে শুরু হয় এই বাঁধের কাজ ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষক ও লোকজনের দাবি, এ পর্যন্ত ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কাজ হয়েছে। অনেক বাঁধে এখনও মাটির কাজই শেষ হয়নি। সঠিক সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ঢলে ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে বোরো ফসলের ক্ষতির আশংকা করছেন কৃষকরা। তাদের অভিযোগ, হাওরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক বাঁধের কাজে ঢিলেমি লক্ষ্য করা গেছে।
জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলার ১২টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরে বোরো ফসলের সুরক্ষার জন্য ৭২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে ১৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারসহ ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এ জন্য সরকার ১১৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
নীতিমালা অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বর বাঁধের নির্মাণ কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ে বাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। মৌসুম শেষ পর্যায়ে এসেও মাত্র ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া বেশিরভাগ বাঁধে ঘাস লাগানো হয়নি, করা হয়নি দুর্মুজ। ডিজাইন অনুযায়ী বাঁধের স্লোপ দেওয়া হয়নি।
গোড়া থেকে মাটি কেটে অনেক বাঁধ নির্মাণ করায় সেগুলো দুর্বল হয়েছে। এর সবই কৃষকদের উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার বরাম হাওরের গুড়খাই (তুফানখালি) ও বোয়ালিয়া বাঁধে ফসল রক্ষা হয় দিরাই-শাল্লা, খালিয়াজুরি, ইটনা-মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের সীমানা পর্যন্ত বড় বড় হাওরের। বোয়ালিয়া বাঁধ এখনই ধসে গেছে। তুফানখালীর বাঁধে এখনো মাটি পড়ছে।
স্থানীয় রাজাপুর গ্রামের কৃষক ছাত্তার মিয়া বলেন, বাঁধগুলোর কাজ আরও আগে শেষ করা জরুরি ছিল।
একই এলাকার আমিরপুরের কৃষক শামছুল হক বলেন, বোয়ালিয়ায় খুবই দুর্বল বাঁধ হয়েছে। এই বাঁধ ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা আছে। ৪-৫ দিন আগে বাঁধে ধ্বস শুরু হয়েছে। তুফানখালীর বাঁধের মাটি কমপেকশন হতে হতে পানি চলে আসবে।
কেবল তুফানখালী বা বোয়ালিয়া নয় সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার সর্ববৃহৎ নলুয়া হাওরের ফসল রক্ষা বেড়িবাঁধের কয়েকটি স্থানে এখনও মাটিই পড়েনি। ফলে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে শঙ্কা বিরাজ করছে।
প্রকল্প কাজের সঙ্গে সম্পৃক্তদের দাবি, কাজের তুলনায় টাকা কম পাওয়া গেছে। সময় মতো অর্থ না পাওয়ায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করা কষ্টকর হয়ে উঠেছে। নলয়া হাওর ঘুরে দেখা যায়, নলুয়ার হাওরের ফোল্ডার-১ এর আওতাধীন ১ নম্বর প্রকল্পে প্রায় ৫০০ মিটার এলাকাজুড়ে এখনও মাটি পড়েনি।
ওই প্রকল্পের তেলিকোণা পাকা সড়কের নিকট থেকে নয়াবাড়ী, নোয়াগাঁও ও কান্দারগাঁও এলাকাসহ প্রায় ৫০০ মিটার স্থানে এখনও মাটি পড়েনি। ৩, ৫, ৬ ও ৭ ও ৮ নম্বর প্রকল্পের বেশকিছু স্থানে মাটি ফেলার কাজ শেষ হয়নি।
নলুয়া হাওরের এক নম্বর প্রকল্পের সভাপতি ফখরুল ইসলাম বলেন, মাটি কাটার মেশিন নষ্ট থাকায় কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে দুই তিনদিনের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে। তিনি জানান, ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ, টাকা পেয়েছি মাত্র ২৫ ভাগ। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে বাঁধের কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
একইভাবে সুনামগঞ্জের দোয়ারা উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের ২১টি পিআইসির বেড়িবাঁধের মধ্যে বেশিরভাগ পিআইসির বাঁধের কাজ এখনও শেষ হয়নি।
স্থানীয় কৃষকেরা জানান, এবার সুরমা ইউনিয়নের ফসলরক্ষা বেড়ি বাঁধের কাজ ভালো হয়নি। কোনো কোনো ফসলরক্ষা বাঁধের বেশিরভাগ অংশে মাটিই ভরাট হয়নি। বাঁধের দৈর্ঘ, প্রস্থ ও উচ্চতার সঠিকতা নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কৃষক জানান, সুরমা ইউনিয়নের ২১টি পিআইসির বেড়ি বাঁধের মধ্যে বেশিরভাগ পিআইসি এখলাছুর রহমান ফরাজি ও তার আত্মীয় স্বজনের নামে রয়েছে। সবকিছু সামলে এবারের পিআইসির বেড়িবাঁধ নির্মাণ একই ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে থাকায় বাঁধের কাজ ভালো হয়নি। সুরমা ইউনিয়নের ১ নম্বর পিআইসি এখলাছুর রহমান ফরাজির নামে আছে।
৩ নম্বর পিআইসি এখলাছুর রহমান ফরাজির চাচাতো ভাই সম্পর্কের আত্মীয় মো. আতাউর রহমান ফরাজির নামে, ২৮ নম্বর পিআইসি আপন ভাতিজা মোশারফ হোসেন ফরাজির নামে রয়েছে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি পিআইসি রয়েছে এখলাছুর রহমান ফরাজির তত্ত্বাবধানে।
সুরমা ইউনিয়নের ১ নম্বর পিআইসির সভাপতি এখলাছুর রহমান ফরাজি বলেন, আমার বাঁধের কাজ শেষ হতে আরও সপ্তাহ-দশদিন লাগবে। একাধিক পিআইসিতে তার স্বজনরা আছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার নিজস্ব ট্রাক, ট্রলি ও এক্সেভেটর আছে। আমি বাঁধে মাটি ভরাটের কাজে ব্যবহার করি। এ জন্য অনেকে বলেন, এসব বেড়ি বাঁধ আমার।
৪-৫ বছর পর পর হাওরে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। যা গত ২০১৭ সালে হাওর বিপর্যয়ের পর শঙ্কামুক্ত ৪টি বছর কাটিয়েছেন কৃষকেরা। কিন্তু জামালগঞ্জ উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারগুলোতে মাটি ও দুরমুজের কাজ কোনো রকম শেষ হলেও বাকি আছে টেকসইকরণের বস্তা ও বাঁশ পোঁতার কাজ। জামালগঞ্জ উপজেলার বদরপুর থেকে শুরু হওয়া হাওড়িয়া আলীপুর পর্যন্ত বাঁধে এখনও দুরমুজের কাজ শেষ হয়নি।
এ বাঁধের ঘনিয়ার বিল সংলগ্ন নদী তীরবর্তী একাংশে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে নদীর বাঁক খাওয়া মোড় থাকায় ধীরে ধীরে ভাঙন আরও প্রবল আকার ধারণ করতে পারে। তখন ঝুঁকিতে পড়বে বিশাল হালি হাওর। এর বিপরীত পাড়ের শনি হাওরের অপর বাঁধে মাটি ফেলার কাজ শেষ হয়নি।
ওই বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারটি মাটিতে ভরাট হলেও বাঁশ পোঁতাসহ অন্যসব কাজ বাকি আছে। এ হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার লালুরগোয়ালা ও তার লাগোয়া বাঁধে মাটি ফেলা শেষ হয়েছে, কিন্তু মাটি ড্রেসিং ও দুর্বা লাগানোর কাজ করতে কাউকে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে, মামুদপুরের ভাঙা থেকে দুর্গাপুর পর্যন্ত ক্লোজারেও বাকি আছে বাঁশ ও বস্তা ফেলার কাজ। দুর্গাপুরের বিপরীত পাড়ের মহালিয়া হাওরের চারটি পিআইসির মধ্যে দুটিতে কেবল মাটি ফেলা শুরু হয়েছে। ওই ৭ ও ৮ নম্বর পিআইসি সংশ্লিষ্ট কাউকে বাঁধে পাওয়া যায়নি। এ হাওরের অপর ২টি বাঁধের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু মদনাকান্দির বিপরীত পাড়ের ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারটিতে বাঁধ টেকসইকরণের কাজ এখনও বাকি আছে।
এ অবস্থায় মহালিয়া হাওরটি অরক্ষিত বলে মনে করছেন হাওরের সচেতন মানুষেরা।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের কামারটুক গ্রামের পাশে খরচার হাওরপাড়ের ৬ নম্বর পিআইসির নির্মিত বেড়িবাঁধে নানা অনিয়ম লক্ষ্য করা গেছে। একেবারে বাঁধের গোড়া ঘেঁষে একাধিক খনতা করে মাটি উত্তোলন করায় বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। এমন অভিযোগ একাধিক কৃষকের।
খরচার হাওরের ৬ নম্বর পিআইসির সভাপতি আবুল বরকত বলেন, বেড়িবাঁধের গোড়া থেকে খনতা করে মাটি উত্তোলন করা হয়েছে। এ ভাবে খনতা করায় বাঁধে কোনো সমস্যা হবে না। ঘাস লাগানো ও দুমুর্জ করার কাজ বাকী রয়েছে।
তবে সবকিছু মিলে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজে চরম অবহেলার চিত্র দেখা গেছে। আগামী এক সপ্তাহেও বাকি কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন হাওর পাড়ের মানুষেরা।
বাঁধের কাজে ঢিলেমিতে অসন্তুষ্ট হাওর বাঁচাও আন্দোলনের নেতারাও। তারা বলছেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বরাবরই নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করে না। ফলে এ নিয়ে লাখ লাখ কৃষক উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক থাকে।
হাওর বাঁচাও আন্দোলনের এক নেতা অঞ্জন পুরকায়স্থ বলেন, সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এ বছর পানি শুকিয়েছে দ্রুত। কিন্তু সময়মতো কাজ শেষ হয়নি। হাওর ঘুরে দেখলাম, মহালিয়ার ৭ ও ৮, হালির ১০ ও ১১, পাগনা হাওরের ২৭ ও ৩৩ নম্বর পিআইসিসহ শনি হাওরের একটি বাঁধে এখনও মাটি ফেলার কাজ চলছে। এর মধ্যে অধিক বরাদ্দকৃত ৩৩ নম্বর পিআইসিতে একটু মাটিও পড়েনি। মহালিয়ার ২টি বাঁধে কেবল মাটি ফেলা শুরু হওয়ায় পুরো হাওরটি অরক্ষিত মনে হয়েছে। সিংহভাগ বাঁধে এখনও দুর্বা লাগানো হয়নি এবং দুরমুজ করা হয়নি প্রায় ২০টি বাঁধে। নির্দিষ্ট সময়সীমা পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কাজ শেষ না হওয়ায় জামালগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ ৪টি হাওর নিয়ে আমরা চিন্তিত।
জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাজেদুল ইসলাম বলেন, হাওরের কাজ আমরা প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করছি। প্রথম দফায় কাজ শেষ না হাওয়াতে আগামী ২০ মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ের বাঁধের কাজ সমাপ্ত করা হবে।
পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজা বলেন, এ পর্যন্ত অনেক বাঁধে মাটির কাজ শেষ হয়নি। মাটি দুরমুজ (কম্পেকশন) ও ঘাস লাগানো হয়েছে আরও কমসংখ্যক বাঁধে। এ ছাড়া নীতিমালা অনুযায়ী ৫০ মিটার দূর থেকে বাঁধের মাটি আনার কথা থাকলেও ৩৫ ভাগ ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি।
কাসমির রেজা বলেন, নীতিমালা অনুযায়ী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সকল হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু এখনো বেশিরভাগ বাঁধে মাটির কাজই শেষ হয়নি। এটি খুব দুঃখজনক। ইতোমধ্যে বৃষ্টি বাদল শুরু হয়ে গেছে। দেরিতে বাঁধ নির্মাণ করলে বাঁধের মাটি নরম থাকে। পানির ধাক্কায় সহজে বাঁধ ভেঙে যায়।
সুনামগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শামসুদ্দোহা বলেন, ‘মাটি ফেলার কাজ মোটামুটি শেষ। আশা করি, দুই-চার দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ শেষ হবে। কৃষকদের শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বৃষ্টি শুরুর আগেই কাজ শেষ হবে।
এমএসপি