রংপুর পাট গবেষণাগারেই আটকে আছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
রংপুরে পাট থেকে তৈরি হচ্ছে আইসক্রিম মেস্তাসত্ত্ব
রংপুরে গবেষণার মাধ্যমে পাট থেকে তৈরি হচ্ছে আইসক্রিম, মেস্তাসত্ত্ব, চা, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ও পানীয়সহ হরেক রকমের খাদ্য পণ্য। পাটের বীজের (ফল) উপরের আবরণ বৃত্তি থেকে উৎপাদিত এসব খাদ্যপণ্য বাজারজাত করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে হাজার কোটি টাকা। গবেষণার মাধ্যমে মেস্তা পাট থেকে বেশ কিছু খাদ্যপণ্য উৎপাদনও করেছে বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনষ্টিটিউটের রংপুর আঞ্চলিক কেন্দ্র। কিন্তু বাজারজাতকরণে শিল্পোদ্যোক্তারা এগিয়ে না আসায় মূল্যবান এসব পণ্যের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা এখনো আটকে আছে গবেষণাগারেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে তিন ধরণের আঁশ ফসল উৎপাদন হয়। এর মধ্যে রয়েছে পাট, কেনাফ ও মেস্তা। আগের দিনে পাটজাতীয় ফসল মেস্তা পাট। গ্রামাঞ্চলে বাড়ির আশপাশে বা রাস্তার ধারে দেখা যেত। অধিকাংশ এলাকায় যাকে চুকুর বলা হয়। যা টক পাট হিসেবে গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে তরকারিতে বা চাটনি বানিয়ে খাওয়া হতো। দেখতে সাধারণ হলেও এই উপগুল্মজাতীয় উদ্ভিদের গুণাগুণ অনেক। আফ্রিকাতে এর পাতা ও ফল থেকে উৎপাদিত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার বেশ সমাদৃত। এরমধ্যে এইচএস-২৪ (কাটাযুক্ত) ও বিজেআরআই-৩ (কাটা ছাড়া) জাতের মেস্তা পাট শুধুমাত্র আঁশের জন্য চাষ করা হয়। যদিও চরাঞ্চলসহ অনুর্বর জমিতে এর চাষ হয় তবে তা পরিমানে বেশি নয়। ২০১০ সালে খাবার উপযোগি সবজি মেস্তা অবমুক্ত করা হয়।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিজেআারআই) সবজি মেস্তা-১ (চুকুর) নামে এর অবমুক্ত করে। শাক-সবজি কিংবা টক হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি এই জাতের পাট থেকেই রকমারি খাবার তৈরির ব্যাপারে গবেষণা চলছে। তবে এই জাত অবমুক্তের পর এখনও তা কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণ করা হয়নি। গবেষণা কেন্দ্রগুলোতে স্বল্প পরিসরে চাষ ও গবেষণা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এজন্য সরকারের পৃষ্টপোশকতা প্রয়োজন। এছাড়া উদ্যোক্তরা এগিয়ে আসলে সম্ভাবনাময় এই মেস্তা পাট একদিন অর্থকরী ফসল হিসেবে কৃষকদের কাছে সমাদৃত হবে।
সূত্র জানায়, ১ বৈশাখ থেকে ৩০ শ্রাবণ পর্যন্ত এই মেস্তা পাট জমিতে বপন করা যায়। একটি মেস্তা গাছে ৪০ থেকে ৬০টি ফল ধরে। বৃতির (যা দিয়ে সুস্বাদু খাদ্যপণ্য তৈরি হয়) ফলন হয় প্রতি হেক্টর জমিতে দুই থেকে আড়াই টন। মেস্তা বেশ খরা সহিষ্ণু এবং পাটের তুলনায় কম উর্বর জমি যেমন চরাঞ্চল ও পতিত জমিতে স্বল্প খরচে চাষ করা যায়। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বন্য প্রজাতির মেস্তা (এম-৭১৫) থেকে বিশুদ্ধ সারি নির্বাচন ও গবেষণার মাধ্যমে অধিক ফলনশীল সবজি হিসেবে খাবার উপযোগী এই উন্নত মেস্তার জাত উদ্ভাবন করেছে। এর কাণ্ড তামাটে রঙের আর শাখা-প্রশাখা বিশিষ্ট। কাণ্ড ও পাতায় কোনো কাঁটা থাকে না। পাতা আঙুল আকৃতির (খন্ডিত), পাতার কিনারা ঢেউ খেলানো ও গাঢ় সবুজ। পরিণত অবস্তায় তামাটে লাল রঙ ধারণ করে, পাতার বিস্তৃত ১০-১১ সেন্টিমিটার। ১৩০-১৪০ দিনে গাছে ফুল আসে। ফুলের ব্যাস ৫-৭ মিলিমিটার, রঙ হলদে, গোড়ায় মেরুন দাগ রয়েছে। ফল অপ্রকৃত, ক্যাপসুল আকৃতির, ওপরের দিকে চোখা ও রোমমুক্ত এবং বৃতি পুরু ও মাংসালো। প্রতি হেক্টরে ৭ হাজার ৭৮৯ কেজি সবুজ পাতা এবং ২০০০-২০৫৫ কেজি বৃতি উৎপাদন হয়। বীজ গাঢ় বাদামি, রেমিফর্ম ও কিডনি আকারের। চুকুরের এক হাজারটি বীজের ওজন প্রায় ২০ গ্রাম। এর খৈল গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায়। বীজ থেকে ২০ শতাংশ খাবার তেল উৎপাদন হয়। মেস্তার তেলে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ পালসিটিক অ্যাসিড, ৬ দশমিক ৮ শতাংশ স্টিয়ারিক অ্যাসিড, ৫১ শতাংশ অলিক অ্যাসিড ও ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ লিনোলিক অ্যাসিড থাকে। মেস্তার তেল পৃথিবীর অনেক দেশে সাবান তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এবং খাবার তেলে মেশানো হয়। মেস্তা পাটের ইংরেজি নাম রোসেলা বা সরেল। এর পাতা ও ফলের মাংসল বৃতি (শাঁস) টক ও সুস্বাদু। পৃথিবীর অনেক দেশেই সবজি হিসেবে মেস্তার বাণিজ্যিক চাষ করা হয় এবং খাদ্য হিসেবে খুবই জনপ্রিয়।
রংপুর ও রাজশাহীতে চুকাই, খুলনা ও সাতক্ষীরায় অম্লমধু, ধামরাই ও মানিকগঞ্জে চুকুল, সিলেটে হইলফা ও কুমিল্লায় মেডশ নামে এটি পরিচিত। এটিকে চাকমারা আমিলা, মগরা পুং ও ত্রিপুরারা উতমুখরই নামে চেনে। কোথাও কোথাও বলা হয় হুগ্নিমুখুই। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এটিকে বলা হয় খড়গুলা। তবে সব শব্দের সরল বাংলা অর্থ টক। বর্তমানে বাংলাদেশে পাট গবেষণা কেন্দ্রের উদ্যোগে স্বল্প পরিসরে মেস্তার চাষ হচ্ছে। এ থেকে তৈরি হচ্ছে চা, মেস্তাসত্ত্ব, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ইত্যাদি।
রংপুরের পাট গবেষণা কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, মেস্তা পাটের কর্তন শুরু হয়েছে। পাটের বীজের (ফল) উপরের আবরণ বৃতি ছড়িয়ে রোদে শুকাচ্ছেন নারী শ্রমিকরা। যা দিয়ে তৈরি হচ্ছে চাসহ হরেক রকম খাবার। অফিসে থরে থরে সাজানো রয়েছে এখানে তৈরি মেস্তাসত্ত্ব, জ্যাম, জেলি, জুস ও আচারের কন্টেইনার। যা দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় আগত অতিথিদের।
পাট থেকে তৈরি হচ্ছে আইসক্রিম, মেস্তাসত্ত্ব, চা, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ও পানীয়সহ হরেক রকমের খাদ্য পণ্য। পাটের বীজের (ফল) উপরের আবরণ বৃতি থেকে উৎপাদিত এসব খাদ্যপণ্য বাজারজাত করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে হাজার কোটি টাকা।
রংপুর চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট মোস্তফা সরোয়ার টিটু বলেছেন, রংপুর আঞ্চলিক পাট গবেষণা কেন্দ্রের পাট থেকে খাদ্য উৎপাদনের গবেষণা এবারেই বিরল ঘটনা। পাট থেকে তৈরি করেছেন আইসক্রিম, মেস্তাসত্ত্ব, চা, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ও পানীয়সহ হরেক রকমের খাদ্য পণ্য। পাটের বীজের (ফল) উপরের আবরণ বৃতি থেকে উৎপাদিত এসব খাদ্যপণ্য বাজারজাত করা গেলে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে হাজার কোটি টাকা। বাজারজাতকরণে শিল্পোদ্যোক্তারা এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
রংপুর আঞ্চলিক পাট গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবুল ফজল মোল্লা জানান, উপগুল্ম জাতীয় এই উদ্ভিদের জনপ্রিয় নাম চুকুর। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন নামে ফলটি পরিচিত। চুকুরপাতা রান্না করে তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়। এর মাংসল বৃতি (শাঁস) থেকে চা, জ্যাম, জেলি, জুস, আচার ইত্যাদি তৈরি করা হয়। চুকুরের পাতা ও ফলে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, কেরোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সি ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান রয়েছে। মেস্তা অর্থাৎ চুকুর পাতার চা হৃদরোগীর জন্য উপকারী, রক্তের কোলেস্টেরলও নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া এর পাতায় রয়েছে ক্যানসার প্রতিষেধক উপাদান। এতগুণ থাকার পরও এর ব্যবহার শুধু গবেষণাগারেই আটকে আছে। রংপুর পাট গবষণা কেন্দ্রে চাসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য প্রস্তুত করে শুধু প্রদর্শনী ও অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। ফসলটি বাজারজাত ও এর গুণাগুণ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পাট গবেষণা কেন্দ্র বিভিন্ন সভা-সেমিনার করেও শিল্পোদ্যোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছে না। এ ফসলটি নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না তারা। আশার কথা ব্যক্ত করে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবুল ফজল মোল্লা আরো জানান, গত বছর পাবনার কয়েকজন তরুণ দুই এক জমিতে মেস্তা পাট চাষ করে লাভবান হয়েছেন।