শুকিয়ে যাচ্ছে নেত্রকোনার নদ-নদী
কংস, মগড়া, সোমেশ্বরী, ধনু, ধলাই অতি পরিচিত হাওর জনপদ নেত্রকোনা জেলার কয়েকটি নদ-নদীর নাম। এ জেলার সমাজ, কৃষি, অর্থনীতি, যোগাযোগ, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে রয়েছে এসব নদ-নদীর প্রভাব ও অবদান। সুদীর্ঘকাল ধরে প্রবহমান এসব নদ-নদী। কিন্ত নির্মম সত্য হচ্ছে, নানা কারণে সেই ঐতিহ্যবাহী নদ-নদীগুলো আজ হারিয়ে যাচ্ছে। নাব্যতা হারিয়ে খালে পরিণত হচ্ছে।
'হাওর অঞ্চল' নেত্রকোনা একটি নদীবিধৌত পলিমাটি গড়া জনপদ। এ জেলার পুরোনো মানচিত্র ও ভূমি রেকর্ডে ৫৭টি নদ-নদী ও ২৮টি বড় খালের (নদীর প্রশাখা) অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে এর বেশিরভাগই আজ নিশ্চিহ্ন। অর্থাৎ মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে যাচ্ছে। ভূতাত্ত্বিকদের মতে, অতীতে কয়েক দফা ভূমিকম্পে এ অঞ্চলের বেশ কিছু নদী-খাল-বিল-জলাশয় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
এর পরবর্তী সময়ে নদ-নদী হত্যার খড়গ হিসেবে আসে স্লুইস গেট, কালভার্টের বাড়াবাড়ি। অপরিকল্পিত রাস্তা-ঘাট-সেতু এবং বাঁধ নির্মাণও নদী মৃত্যুর বড় কারণ। এসব অত্যাচারের কারণে এক সময় যেসব খরস্রোতা নদী ছিল গোটা নেত্রকোনার প্রাণ এবং কৃষি, যোগাযোগ ও প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার গুরুদায়িত্ব পালন করত যে প্রকৃতিকন্যারা; আজ তারা মৃত, মৃতপ্রায় বা স্রোতহারা।
নেত্রকোনা জেলা শহরের বুক চিরে প্রবাহিত একটি নদীর নাম ‘মগড়া’। মূলত এ নদীকে কেন্দ্র করেই ব্রিটিশরা এক সময়ের ‘কালীগঞ্জ’ বাজারে প্রতিষ্ঠা করেছিল নেত্রকোনা শহর। অতীতে মগড়া ছিল বেসামাল ও উত্তাল। কোনো বাধাই মানত না। আঞ্চলিক ভাষায় এরকম বদমেজাজি বা বিধ্বংসী চরিত্রকেই বলা হয় ‘মগড়া’। কিন্তু আজ আর মগড়ার সে স্বভাব নেই।
উৎসমুখ ভরাট ও পূর্বধলার ত্রিমোহনীতে স্লুইস গেট নির্মাণের কারণে কিংবদন্তীর মগড়া আজ প্রায় মরা, স্রোতহারা। কোথায়ও কোথায়ও ফসলের মাঠ। দখলদাররা দিন দিন দখল করে নিচ্ছে এর বিস্তীর্ণ এলাকা। এটি আজ কচুরিপানা, ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি এক জলাশয়ে পরিণত হয়ে যায় শীতকালে।
জেলা শহরের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ‘ধলাই’। স্থানীয় ভাষায় ‘ধলা’ শব্দটি ‘স্বচ্ছ’ বা ‘সাদা’ শব্দের প্রতিশব্দ। প্রচলিত আছে, ধলাইয়ের পানি এতই স্বচ্ছ ও টলটলে ছিল যা রোদের আলোতে ‘সাদা’ মনে হতো। ঝিকমিক করত। আর এ কারণেই নদীটির নাম হয়েছিল ‘ধলাই’। এককালের বেগবতী ধলাইয়ের কোনো কোনো অংশে এখন পায়ের পাতাও ভেজানো যায় না।
সুসং রাজ্যের ইতিহাস খ্যাত ‘সোমেশ্বর পাঠক’ এর নাম থেকে পাহাড়ি জনপদ দুর্গাপুরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ‘সোমেশ্বরী’। মেঘালয়ের পাদদেশ থেকে নেমে আসা এ নদীটির চরিত্রও বিচিত্র। শুষ্ক মৌসুমে এটি ধু ধু বালুচরে পরিণত হয়। বর্ষায় হয়ে ওঠে ভয়াল-বিধ্বংসী। সামান্য বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলেই উপচে পড়ে নদীটির দুই কূল। ফলে বন্যা ও ভাঙনের শিকার হয় বিশাল জনবসতি। এদিকে বর্ষায় পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে এ নদীপথ দিয়ে বয়ে আসে বিপুল পরিমাণ সিলিকা বালি।
নদী উপকূলে এ বালির স্তর পড়ে প্রতি বছর মরুভূমির মতো বিরাণ প্রান্তরে পরিণত হয় বিস্তীর্ণ কৃষি জমি। আর এসব কারণে বলা যায়, পাহাড়ি জনপদের দুঃখ হয়ে উঠেছে সোমেশ্বরী।
দুর্গাপুর ও কলমাকান্দার ওপর দিয়ে প্রবাহমান আরও দুই পাহাড়ি নদীর নাম ‘আত্রাইখালি’ ও ‘উব্দাখালি’। সোমেশ্বরীর দুই বোন। সোমেশ্বরীর মতো এরাও ‘কীর্তিনাশা’। অনেক কীর্তিই নাশ করেছে। বর্ষায় এদের উপচে পড়া পানিতে সৃষ্ট বন্যা ও ভাঙনে ক্ষতির শিকার হয়েছে অনেক জনবসতি। ধু ধু বালুরাশিতে পরিণত করেছে অনেক আবাদি জমি। বালি আর পলির স্তর জমে প্রকৃতির এ দুই কন্যাও আজ মৃত্যুর প্রহর গুণছে।
এদিকে কলমাকান্দার লেঙ্গুরা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত আরেক বিচিত্র জলধারার নাম ‘গণেশ্বরী’। গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা এ নদীটি অনেকটা ঝরনার মতো। বর্ষায় গণেশ্বরী প্রচণ্ড খরস্রোতা হয়ে উঠলেও শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে খাঁ খাঁ করে। গতি পথের বিভিন্ন স্থানে বালির স্তর জমতে জমতে অপার সৌন্দর্যের গণেশ্বরী এখন মৃত্যুপথযাত্রী।
নেত্রকোনা সদর, বারহাট্টা ও মোহনগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ‘কংস’ নদ। এটি জেলার দীর্ঘতম একটি জলধারা। শৈশব-কৈশোরে কংসের প্রমত্তা রূপ দেখে কবি নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন ‘একবার এসেই দেখুন কংস নদের সঙ্গে সমুদ্রের বেশ মিল আছে…/এখানে গর্জন আছে, শোঁ শোঁ শব্দে হাওয়া ছোটে রাতে/ঢেউ এসে সজোরে আছড়ে পড়ে তীরের নৌকোয়’। কিন্তু দিনে দিনে এর বিস্তীর্ণ অংশ ভরাট হয়ে গেছে। পূর্বধলা ও বারহাট্টার বিভিন্ন এলাকায় কংসের বুক জুড়ে চলছে চাষাবাদ।
জেলার সবচেয়ে খরস্রোতা নদীর নাম ‘ধনু’ (ধেনু)। এটি সুরমার একটি ধারা। হাওড় উপজেলা মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরির ওপর দিয়ে প্রবাহিত এ নৌপথকে কেন্দ্র করেই ভাটি অঞ্চলের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকার নৌপথ গড়ে ওঠেছিল। কিন্তু নদীর বুকে জেগে উঠেছে অসংখ্য চর। শুষ্ক মৌসুমে এসব চরে কার্গো, লঞ্চ, ট্রলার আটকে যায়। ফলে ব্যাহত হয় নৌ-পরিবহন।
মানচিত্রে মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরি উপজেলাকে বিভক্ত করেছে ‘চিনাই নদী’। ঝিনুকের আঞ্চলিক নাম ‘চিনাই’ থেকে এর নামাকরণ। ২০-২৫ বছর আগেও এর জলধারা ছিল সচল ও প্রবহমান। কিন্তু গতিপথ রুখে দেওয়ার কারণে ‘চিনাই’ আজ শীর্ণকায়, নীরব, নিথর। একই অবস্থা মোহনগঞ্জের ঘোরাউৎরা ও সাপমারা নদীর। এ ছাড়াও অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে ঠাকুরাকোনার ধনাইখালি, সলি বুবিজান, বারহাট্টা ও কলমাকান্দার মাঝামাঝি গোলামখালি এবং মদনের বালই নদী। অন্যদিকে নেত্রকোনার ৩৪টি নদ-নদী ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে বা মরা খালে পরিণত হয়েছে।
হারিয়ে যাওয়া নদ-নদীগুলো হচ্ছে- তেওড়াখালি, ধুপিখালি, লাউয়াড়ি, সুরিয়া, সাইডুলি, কানাই, কাওনাল, সোনাই, বাউরী, ছিলা, তুষাই, বিষনাই, বেতাই, পাতকুড়া, সতি, বারুনী, ছেলা, বলী, নয়া নদী, পিয়াইন, নিতাই, বাঁকহারা, কালীহর, বল, বালিয়া, গুনাই, কানসা, রাজেশ্বরী, পাটেশ্বরী, ফুলেশ্বরী, কালিয়ারা, ধোপকলা, জলকান্দি, জল শিমুলকান্দি নদী। মানচিত্রে থাকলেও বেশকিছু নদীর এখন আর কোনো অস্তিত্বই নেই। কোনো কোনোটি টিকে আছে একবারেই সরু খাল বা নালার আকারে।
নদ-নদীগুলো বিলুপ্ত হওয়ায় মহাশোল, বাঘাআইড়সহ নানা প্রজাতির মাছেরও আর দেখা মিলে না। অন্যদিকে জেলার নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থাও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কাজ হারিয়ে পেশা বদল করেছেন মাঝি-মাল্লারা। বদ্ধ জলাশয়ের নামে বেশকিছু নদী ইজারা বন্দোবস্ত দেওয়ায় বেকার হয়ে পড়ছেন মৎস্যজীবীরা।
তবে নদ-নদীর অস্তিত্ব সঙ্কটে পোয়াবারো অবস্থা চলছে দখলদারদের। অনেকটা বাধাহীনভাবেই নদ-নদীর বিস্তীর্ণ অংশ দখল করে নিচ্ছেন তারা। এসব প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার কোনো অভিভাবকই যেন নেই এখানে!
এসব নদ-নদী রক্ষায় অপরিকল্পিত বাঁধ, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ও স্লুইসগেট নির্মাণ বন্ধ করতে হবে বলে মনে করছেন পরিবেশ সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয়রা। তারা বলেন, সচল করতে হবে নদীর গতিপথ। পরিকল্পনা মাফিক খনন করলেই হয়ত আগামী দিনেও এ নদ-নদীগুলো পানিসম্পদ, সেচ, যোগাযোগ আর প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। তাই প্রতিদান হিসেবে নয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই এ প্রকৃতিকন্যাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে।
বারহাট্টা উপজেলার কংস নদের তীরে অবস্থিত রূপগঞ্জ বাজারের বাসিন্দা রঞ্জন কুমার সাহা জানান, আমি আমার জীবনে এ কংস নদের প্রবল স্রোতে ভেসে সাঁতার কেটেছি। নদীতে পালতোলা নৌকা ছিল। প্রচুর পরিমাণে মাছ ছিল। এখন এ বসন্তকালে এর তলদেশে কোনো পানি নেই। এটি খনন করলে হারানো পরিবেশ ফিরে পাওয়া যেত।
খালিয়াজুরীর ধনু নদীর তীরে অবস্থিত নয়াগাও গ্ৰামের কূষক সুশীল তালুকদার বলেন, স্লুইচ গেট ও বাঁধ তৈরিতে কোনো নিয়ম মানা হচ্ছে না। নদী সঠিকভাবে খনন, সেতু নির্মাণ ও নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন। এতে মাছ উৎপাদন বাড়বে। নদী পথে যোগাযোগ সহজ হবে। বোর ধান চাষে সেচ ও ফসল অকাল বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাবে।
হাওর উন্নয়ন ও মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মো. ইকবাল হোসেন বলেন, দিনে দিনে এ নদ-নদী ভরাট, বিলীন ও গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এলাকার কৃষি, যোগাযোগ, মৎস্য, অর্থনীতি ও পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর। হাওর অঞ্চলে নদ-নদী রক্ষা করা ও উন্নয়ন করতে চাই হাওর উন্নয়ন মন্ত্রণালয়। এতে সঠিকভাবে গবেষণা করে টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প গ্ৰহণ ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এমএল সৈকত এ বিষয়ে বলেছেন, জেলার হাওর অঞ্চলের নদ -নদীর নাব্যতা সংকট নিরসনে সরকারের মহাপরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ উপজেলায় নদী খনন কাজ শুরু ও করা হয়েছে। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাচ্ছি নিয়মিত।
এসএন