অভিযোগ নিষ্পত্তির পরও উজিরকে থানায় নিয়ে পুলিশের নির্যাতন
গত ৯ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের শত্রুমর্দন গ্রামের উজির মিয়ার বাড়ি ঘেরাও করেন প্রায় ২০ জন পুলিশ সদস্যরা। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে দরজা খুলতে বলা হয়। এ সময় উজির মিয়া দরজা খুলতে নাখুলতেই পুলিশ তার হাতে থাকা টর্চলাইট দিয়ে আঘাত উজির মিয়ার মাথায় করে। এরপর লাঠি দিয়ে তার হাতে আঘাত করে তারা। তারপর বসতঘর থেকে বাহিরে নিয়ে উজির মিয়ার পায়ে আঘাতের পর আঘাত করতে থাকেন পুলিশ সদস্যরা। তখন উজির মিয়ার বোন পুলিশের পায়ে ধরে না মারার অনুরোধও করেন। তারপরও টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। এভাবেই উজির মিয়াকে আটকের সময় নির্যাতন করা হয়েছে বলে ঢাকা প্রকাশকে জানান তার বোন সিপা বেগম।
শুধু আটকের সময়ই নয়, থানায় নিয়ে যাওয়ার পরও উজির মিয়ার উপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয় বলে জানা গেছে। ওই দিন রাতে আটক হন একই গ্রামের শহীদুল ইসলাম ও আক্তার মিয়া নামের আরও দুই যুবক। তাদের ওপরও চলে নির্যাতন। উজির মিয়ার সঙ্গে ওই রাতে আটক হওয়া শহীদুল ও আক্তার মিয়া ঢাকাপ্রকাশকে জানান, শান্তিগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়ার পর গামছা দিয়ে বেঁধে, উল্টা করে ঝুলিয়ে ব্যাপক মারধর করা হয়। ভয়াবহ নির্যাতনের এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে যান উজির মিয়া।
আক্তার মিয়া আরও বলেন, আমাকে ধরে নেওয়ার পর থানায় নিয়ে প্রথমে এসআই দেবাশিষ এবং আরও ২ জন পুলিশ আমাকে লাঠি দিয়ে খুব মারেন। পুলিশের কথামতো নিজেকে চোর স্বীকার না করায় সবাইকে এক রুমে আনা হয়। তখন উজির ভাইয়ের হাতে হ্যান্ডকাফ লাগানো হলো, আমাদেরও লাগাল। দুটি টেবিল কাছাকাছি এনে দুই টেবিলের মাঝখানের অংশে উজির ভাইকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। পরে এসআই দেবাশিষ তাকে অনেক জোরে লাঠি দিয়ে মারতে থাকেন। এ সময় উজির ভাইকে চোর স্বীকার করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। গরু চুরির সঙ্গে উজির ভাই জড়িত এটা স্বীকার করার জন্য আমাকে মারতেই থাকে। আমি মার সহ্য করতে না পেরে মাথা নাড়লে তারা শান্ত হয়।
আরেক যুবক শহীদুল ইসলাম বলেন, আমাকে কিছু না বলেই কয়েকজন পুলিশ বাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে আমাকে শান্তিগঞ্জ থানায় নিয়ে যায়। রাত ১টার সময় থানায় পৌঁছানোর পর আমাদের আলাদা আলাদা রুমে রেখে মুখে গামছা বেঁধে শুরু করে মারধর। তখন লড়তেও পারি না। মুখ খুলে কানতেও পারি না। মার খেতে খেতে দুনিয়ার সবকিছুই ভুলে গেছি কেবল জানটা বাঁচানোর চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই ছিল না আমার। তখন আরেকটা রুমে উজির ভাইকে কীভাবে মেরেছে তা দেখিনি। কিচ্ছুক্ষণ পরে আমার সামনে এনে হাতকড়া লাগিয়ে লুঙ্গি মালকোঁচা বেঁধে প্রথমে সারা শরীরে লাঠি দিয়ে পিঠিয়েছে পুলিশ। তারপর দুই পায়ের তলায়। আমারও পায়ের তলায় লাঠি দিয়ে মারতে থাকে। মার খেতে খেতে অজ্ঞান হলে পুলিশ হাসি-ঠাট্টা করত, অভিনেতা বলত। ’তুই চোর বল তুই চোর' বলেই নির্যাতন করত পুলিশ। আর্তচিৎকার করলে চোখ-মুখ বেঁধে ফেলা হয়। ভয়াবহ নির্যাতনের এক পর্যায়ে রাত সাড়ে ৩টার দিকে উজির ভাই অজ্ঞান হয়ে গেলে আর জ্ঞান ফিরে না, তখন উজির ভাইসহ আমাদের তিনজনকে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশরা।
সূত্র জানায়, সেই রাতে শহীদুল ও আক্তারকে বহির্বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে শান্তিগঞ্জ থানায় ফিরিয়ে আনা হলেও উজিরকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। পুলিশ হাসপাতালে দাবি করে, চুরি করতে গিয়ে গণধোলাইয়ের শিকার হয়েছে তারা। সকালে উজির মিয়াকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হলে তাকে থানায় আনা হয়। এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি সকালে গরু চুরির মামলায় উজির, শহীদুল, আক্তার ও শামীম মিয়া নামে আরেকজনকে আদালতে হাজির করা হয়। আইনজীবীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত উজির, শহীদুল ও আক্তারের জামিন মঞ্জুর করেন।
জামিনে মুক্তির পরদিন (১১ ফেব্রুয়ারি) গুরুতর অসুস্থ উজির মিয়াকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে ভর্তি করেন। পরদিন হাসপাতালের নিউরো সার্জারি ওয়ার্ড থেকে দেওয়া ছাড়পত্রে তার অসুস্থতার কারণ হিসেবে 'ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট (শারীরিক আঘাত) উল্লেখ করা হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি বাড়ি ফেরার পর থেকে বাড়িতেই ছিলেন উজির। এরপর (২১ ফেব্রুয়ারি ) সকালে হঠাৎ তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে দ্রুত সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে অবস্থার আরও অবনতি হয়। পরে রাস্তায় সুনামগঞ্জ ছাতক উপজেলা কৈতক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
উজির মিয়া মারা যাওয়ার সংবাদে পুলিশের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন এলাকাবাসী। শান্তিগঞ্জ থানার এসআই দেবাশীষের ফাঁসির দাবিতে ২১ ফেব্রুয়ারি দুপুরে উজির মিয়ার মরদেহ নিয়ে বিক্ষোভ ও সুনামগঞ্জ-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করেন জনতা। সেই সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনোয়ার উজ জামানকে বহনকারী একটি গাড়ি উজির মিয়ার মরদেহকে চাপা দিয়ে চলে যায়। এ ঘটনায় এলাকায় আরও বেড়ে যায় ক্ষোভ। এক পর্যায়ে সুনামগঞ্জের সঙ্গে সারা দেশের যান চলাচল বন্ধ করে দেয় বিক্ষোভকারীরা। মরদেহকে চাপা দেওয়া গাড়িটি ছিল উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনারের। তবে গাড়ির ভেতরে বসা ছিলেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনোয়ার উজ জামান। এ প্রসঙ্গে ইউএন আনোয়ার উজ জামানের দাবি, তাকে বহনকারী গাড়িটি মরদেহকে চাপা দেয়নি। তবে এ ঘটনার দুটি ভিডিও ক্লিপ আসে ঢাকাপ্রকাশের কাছে।
এদিকে উজিরের পরিবার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও মামলার সাক্ষীদের সঙ্গে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার কথা বলে জানা গেছে, উজির মিয়াকে চুরির যে মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। সেই অভিযোগের বিষয়টি গ্রাম্য সালিশে আপস-মীমাংসা হয়ে গিয়েছিল। এরপর থানায় একটি আপসনামাও জমা দিয়েছিলেন বাদী। আপসে অভিযোগ নিষ্পত্তির পরও উজির মিয়াকে আটক করে নিয়ে যায় পুলিশ। পুলিশের এক উপপরিদর্শকের (এসআই) আত্মীয়ের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে উজিরকে পরিকল্পিতভাবে আটক ও নির্যাতন করারও অভিযোগ তাদের। আর যে গরু চুরির মামলায় তাকে আটক করা হয়, থানায় জমা দেওয়া সেই মামলার এজাহারেও ছিল না উজিরের নাম।
প্রসঙ্গত, গত ১৩ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার দরগাপাশা ইউনিয়নের আমরিয়া গ্রামের বাসিন্দা নুর উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির একটি গরু হারায়। পরে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার একটি বাজারে গরু ও অটোরিকশাসহ চারজনকে আটক করে স্থানীয়রা। খবর পেয়ে শান্তিগঞ্জ থানার এসআই দেবাশীষসহ কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান নুর উদ্দিন। সেখান থেকে গরু ও অটোরিকশা উদ্ধার এবং চারজনকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। পরদিন এই চারজনসহ অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে থানায় গরু চুরির মামলা করেন নুর উদ্দিন। কিন্তু এই মামলায় উজির মিয়াকে কেন আটক করা হলো? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজতে ঢাকা প্রকাশের টিম অনুসন্ধানে করে উপজেলার পশ্চিম পাগলা ও দরগাপাশা দুই ইউনিয়নে।
এ প্রসঙ্গে মামলার চার নম্বর সাক্ষী ও দরগাপাশা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনির উদ্দিন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, গরু আটকের পর বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা থেকে একজন আমাকে কল দেন। আমি গরুর মালিক নুর উদ্দিনকে খবরটি জানাই। এরপর জানতে পারি এই ঘটনায় যাদের আটক ও মামলায় আসামি করা হয়েছে তারা সকলেই আমার গ্রামের। পরে লোকজন আমার কাছে এসে বিষয়টি আপসে নিষ্পত্তির অনুরোধ করেন। তাদের অনুরোধে নুর উদ্দিনকে আপসের প্রস্তাব দেই। ক্ষতিপূরণও দেওয়া হবে নুর উদ্দিনকে জানাই। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে ওই রাতেই নুর উদ্দিন থানায় আপসের কথা জানান। এর প্রেক্ষিতে পরদিনই সব আসামি আদালতের মাধ্যমে জামিন পান।
এরপর গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি আপসে নিষ্পত্তি হয়েছিল বলে জানান মামলার সাক্ষী মতচ্ছির আলী। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ‘নুর উদ্দিনের গরু উদ্ধার, মামলা দায়ের, সালিশ বৈঠক সবকিছুতেই আমি ছিলাম। কিন্তু এ ঘটনায় উজিরের সম্পৃক্ততার কথা কেউ বলেননি। বাদীও তার নাম বলেননি। উজিরকে ভালো ছেলে বলে জানি। তবুও তাকে কেন আটক করা হলো তা পুলিশই ভালো বলতে পারবে।
মামলার বাদী নূর উদ্দিন ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, পুলিশের কথায় আমি অভিযোগ দেই। এরপর গ্রামের মানুষ মামলা তুলে নেয়ার জন্য বলেন। আমি তাদের কথায় আদালতকে আপসের বিষয়টি জানাই।
তিনি আরও বলেন, আমি উজির মিয়াকে চিনিই না। আমার গরু যারা চুরি করছে তারা হাতেনাতে আটক হয়েছে। চার আসামি জামিন হওয়ার পর এ ঘটনায় পুলিশ তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। উজির মিয়া আটক হওয়ার বিষয়টিও আমি জানি না।
এ ব্যাপারে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মুক্তাদির হোসেন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে পুলিশের নির্যাতনে উজির মিয়ার মৃত্যুর অভিযোগ তদন্তে সময় বাড়ানো হয়েছে আরও তিন দিন। জেলা প্রশাসনের গঠিত কমিটি গত বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) বিকালে এ সময় বাড়ানোর আবেদন করে। এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সাঈদ বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর সঠিক কারণ জানা যাবে। যেহেতু আমাদের দুই–একজন সদস্যকে নিয়ে কথা উঠেছে। তাই বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছি। আমাদের কোনো ভুল-ত্রুটি আছে কি না, আমরা সেটিও দেখব।
এ ব্যাপারে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, পুলিশ হোক, অফিসার হোক যে কেউ যদি বারাবারি করে আইন লঙ্ঘন করে তার বিরুদ্ধে আইনের মাধ্যমে বিচার করব।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ সময় সৌদি আরবে ছিলেন উজির মিয়া। দেশে ফিরেন সাত বছর আগে। দেশে এসে প্রথমে দোকান দিলেও পরে ছোটখাটো বিল ইজারা নিয়ে মাছের ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
এসআইএইচ