ভেড়ামারায় ২ সন্তানের জননীকে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ২ সন্তানের জননীকে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে তার স্বামীর বিরুদ্ধে।
শনিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) বিকাল ৫টার দিকে ভেড়ামারা উপজেলার বাহিরচর ইউনিয়নের ষোলদাগ গ্রামে ষোলদাগ মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন জাকিরুলের কলা বাগান থেকে বিভৎসভাবে আগুনে পোড়া এক গৃহবধূর মরদেহ উদ্ধার করে ভেড়ামারা থানা পুলিশ।
প্রাথমিকভাবে জানা যায়, মরদেহটি একজন নারীর এবং বয়স আনুমানিক ২৭ বছর। প্রথমে মরদেহটির নাম বা পরিচয় পাওয়া না গেলেও চাঞ্চল্যকর ঘটনাটি মুহূর্তের মধ্যে ভেড়ামারাসহ আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাস্থলে উৎসুক জনতা ভীড় জমায় এবং সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় খোঁজখবর। খোঁজখবরের এক পর্যায়ে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হতে শুরু করে।
সূত্রে জানা যায়, উদ্ধারকৃত মরদেহটি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া ইউনিয়নের জ্যোতি তেল পাম্প এলাকার সিরাজুল বিশ্বাস ও সালেহা বেগমের মেয়ে সজনীর। গত ১৪/১৫ বছর আগে ভেড়ামারার ষোলদাগ এলাকার সলিম মন্ডলের ছেলে লালনের সঙ্গে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় সজনীর। তিনি এক ছেলে ও এক কন্যা সন্তানের জননী। তিনি কয়েকদিন আগে ছেলে ও মেয়েকে স্বামীর বাড়িতে রেখে একাই বাবার বাড়িতে চলে আসেন। লালন দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন বলে জানা যায়।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি স্বামী লালন এসে জোর করে সজনীকে তার বাবার বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। সেই সময় সজনী তার পরিবারের লোকজনকে পাঠাতে নিষেধ করলেও তাকে তার স্বামীর সঙ্গে পাঠানো হয়। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় সজনী তাকে নির্যাতনের বিষয়টি তার ফুফু বেগমকে জানান। তবে কী কারণে নির্যাতন করা হতো তা জানায়নি।
নিহতের স্বজনরা জানান, 'জামাইডার মনে হয় অন্য জায়গায় সম্পর্ক ছিল। বিয়ের চৌদ্দ-পনের বছরে তাদের মধ্যে কোনো সমস্যা না থাকলেও গত সাত-আট মাস জামাই মেয়েটাকে খুবই হাল অবস্থা করে।' বাবার বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার পর কোনো এক এনজিও থেকে সজনীর নামে স্বামী লালন লোন তুলেছে বলেও জানা গেছে।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় লালন তার শ্বশুরের কাছে ফোন করে কুশলাদি বিনিময় করেন বলে জানান সজনির ফুফু বেগম। কিন্তু ঐ দিন রাত আনুমানিক ১০টার সময় জামাই লালন তার শ্বশুরকে ফোন করে জানায় সজনীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লোন উঠানো ৫০ হাজার টাকার মধ্য থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে সজনী অন্য কারো সঙ্গে ভেগে গেছে বলে শ্বশুরের কাছে অভিযোগ করেন লালন।
সজনীর ফুফু বেগম আরও জানান, ঘটনা শোনার পর পরই আমরা মেয়েকে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোঁজাখুজি শুরু করি। কিন্তু কিছুক্ষণ পর লালন (জামাই) আবার ফোন করে বলেন, আপনাদের মেয়ে বাসায় আছে আপনারা চলে আসেন। সেই মোতাবেক নিহত সজনীর ফুফু, মা পরিবারের অন্য সদস্যরা লালনের বাড়িতে গেলে লালন তাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে বলে, 'তোরা কোন জায়গায় আমার বৌকে রেখে এসেছিস, কার সাথে বার করে দিছিস, তাড়াতাড়ি মেয়ে দে।' তখন সজনীর বাড়ির লোকজন লালনকে বলে, 'তুমি জোর করে মেয়ে নিয়ে না আসলে এই ঘটনা ঘটত না।' সেই সময় লালন নিহত সজনীর বাড়ির লোকজনকে মারধর করেন বলেও সজনীর ফুফু জানান।
তিনি আরও জানান, তাদের উপরে সেই সময় লালন দফায় দফায় মারধর করে। পরবর্তী কালে আমরা ঐ এলাকার মহিলা চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু চেয়ারম্যানকে আমরা পাই নাই।
বেগম আরও জানান, আমরা বাড়িতে ফিরে এসে আমাদের তালবাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ এলাকার মণ্ডলদের বিষয়টা জানাই। এই ঘটনার পর লালন আমাদের হুমকি দিয়ে বলে, 'শোন তোরা আমার কিছু করতে পারবি না। থানা কোর্ট সব আমরা কিনে নিছি। আমার কিচ্ছু করতি পারবি না। আমরা মারি ফেলা দিছি, তোদের যা ইচ্ছা করগা। তোরা আমার কিচ্ছু করতি পারবি না।'
বেগম আরও বলেন, 'শুক্রবার আমরা মিরপুর থানায় গিয়েছিলাম কিন্তু ছবি না থাকার কারণে আমরা থানায় জিডি বা মামলা করতে পারি নাই। জামাইয়ের (লালন) কাছে ছবি চাইলে সে সকালে ছবি নিয়ে আসবে বলে জানায়। কিছুক্ষণ পরে সে আবার ফোন করে জানায়, ফটো দেওয়া যাবিনানে। কাল সকাল ১০টার সময় সাংবাদিক আসবে, আমার ছেলে আর মেয়ের ফটো তুলে টিভি চ্যানেলে দিবি। আপনি টেনশন কইরেন না। আমি আগামীকাল (শনিবার) ঢাকায় আপনার মেয়েকে খুঁজতে যাব।'
গতকাল শনিবার বেলা ৩টার দিকে নিহতের বাবা সিরাজুল বিশ্বাস মেয়ের ছবি নিয়ে ভেড়ামারা থানায় গিয়েছিলেন বলেও জানা যায়। এই বিষয়ে ভেড়ামারা থানায় একটি মামলা দায়ের হয়।
পরবর্তীতে সিরাজুল বিশ্বাসের চাচাতো ভাই আনন্দ নামের একজন ষোলদাগ এলাকার মেম্বারের কাছে ফোন করে সজনী নিখোঁজের বিষয়টি জানান। পরবর্তীকালে মেম্বার খোঁজখবর নিয়ে জানান তাদের বাড়ির পাশে কলাবাগানে একটি মহিলার লাশ পাওয়া গেছে। আপনারা আসেন। এসে দেখেন আপনাদের মেয়ে কি না।
বেগম আরও বলেন, 'সজনীকে পেট্রোল ঢেলে এমনভাবে পুড়িয়ে দিয়েছে যে, কোনী চিহ্ন নাই। আমরা পায়ের আঙ্গুল দেখে চিনতে পেরেছি।' পরবর্তীকালে মেয়ের বাবা থানায় অভিযোগ দায়ের করেন বলেও তিনি জানান।
এদিকে চাঞ্চল্যকর এই হত্যকাণ্ডের মূল হোতা স্বজনীর স্বামী লালন কোথায় আছে তা কেউ জানে না। ঘটনা প্রকাশ হওয়ার খবর পেয়ে সে গা ঢাকা দিয়েছে। এলাকাবাসী ও নিহতের পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, বৃহস্পতিবার রাত ১০টার আগে বা পরে সজনীকে হত্যা করে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
মিরপুর থানায় সজনীর বাবা সিরাজুল বিশ্বাস শুক্রবার গিয়েছিলেন কি না এই বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গোলাম মোস্তফা জানান, আমি শুক্রবার ছিলাম না। এই বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
ভেড়ামারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মজিবুর রহমান জানান, স্থানীয়দের খবরে আমরা বাহিরচর ইউনিয়নের ষোলদাগ গ্রামের জাকিরুলের কলাবাগান থেকে আগুনে পোড়া অবস্থায় অজ্ঞাত এক নারীর মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসি। ইতিমধ্যে লাশের পরিচয় পাওয়া গেছে। মরদেহটি ময়না তদন্তের জন্য কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এ ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে বলেও জানান তিনি।
টিটি/