বিউটি পার্লারে কর্মসংস্থান, স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তরুণীরা
বাংলায় একটি প্রবাদ বাক্য আছে, 'যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে'। আজকের একবিংশ শতাব্দীর সন্ধিলগ্নে এসে দাঁড়িয়ে এই প্রবাদ যে কতখানি সত্য এবং যুক্তিযুক্ত তা বোধ হয় কারো কাছেই অবিদিত নয়। কারণ আজকের নারী অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল। প্লেন-ট্রেন চালানো থেকে শুরু করে গাড়ির ড্রাইভিং, ফুটবল, ক্রিকেট, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, আনসার, গ্রাম-পুলিশ এবং বিভিন্ন অফিস-আদালতে সর্বত্রই মেয়েদের অবাধ বিচরণ। এছাড়াও রাজনীতিতেও তারা অনেকটা এগিয়ে।
আর কাজের ক্ষেত্রটি যদি হয় রুপচর্চা সম্পর্কিত সেক্ষেত্রে তো মেয়েদের জুড়ি মেলা ভার। সেই আদিকাল থেকেই রুপ চর্চায় মেয়েরা সিদ্ধহস্ত। আর ইদানীংকালে সেই রূপচর্চাই হয়ে উঠেছে পেশাগত দিক থেকে এক অভাবনীয় ক্ষেত্র। আর ঠিক সেই কারণেই বাড়ছে বিউটিশিয়ান কোর্সের চাহিদা। প্রফেশনাল ট্রেনিং নিয়ে মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে অনেকে।
অপরদিকে, রুপচর্চা ও প্রসাধনের জন্য বিউটি পার্লারে যান না এমন ফ্যাশন অসচেতন বঙ্গললনা পাওয়া দুর্লভ। নারীদের বড় একটি কর্মের স্থানজুড়ে আছে বিউটি পার্লার। এর জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সীমিত আকারে হলেও ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামগঞ্জের আনাচে কানাচে।
আদিবাসী নারীদের পাশাপাশি বাঙালি নারীরাও বিউটিশিয়ানের প্রশিক্ষণ নিয়ে পার্লারের কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। পরিপাটিভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে তোলার মাধ্যমে গৃহবধূ তথা কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীরাও হতে পারছেন স্বাবলম্বী।
তরুণীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয়ের অধীন নারীদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলতে বিনামূল্যে এমনই বিউটিশিয়ানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, দুই প্রশিক্ষক নারীদের সাজিয়ে দিচ্ছেন শেখানোর জন্য। প্রশিক্ষণার্থীরা মনোযোগ দিয়ে দেখছেন রুপচর্চার কাজ। প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া কেউ পড়াশোনা করছেন, কেউ বা গৃহিণী।
উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ জুন ২০২১ শুরু হয়ে এবছর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উপজেলা উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে জাইকার সহযোগিতায় বিনামূল্যে বিউটিশিয়ানের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। এতে দুইজন প্রশিক্ষক ২০ নারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের সনদপত্র ও সম্মানী ভাতা দেওয়া হয়েছে।
সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীরা অনেকেই কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি স্বাবলম্বী হচ্ছেন। উপজেলা মহিলা বিষয়ক কার্যালয় থেকে ৬ মাস আগে বিউটিশিয়ানের প্রশিক্ষণ নেন নুসরাত জাহান। বর্তমানে তিনি অন্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এ ছাড়া, তার সঙ্গে যেসব নারী প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ হোম পার্লার বা পার্লারের দোকানে কাজ করছেন।
প্রশিক্ষণার্থী রেহানা পারভীন সুমি ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, 'প্রশিক্ষণটি একজন নারীর জন্য খুবই দরকার। কর্মক্ষেত্রে না হোক, নিজে বা পরিবারের নারীদের রুপচর্চা ও প্রসাধনের বিষয়ে কাজে লাগবে। এছাড়া, এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবো। প্রশিক্ষণে অনেক কিছু জানতে এবং শিখতে পেরেছি। তবে প্রশিক্ষণটি মাসব্যাপী হলে ভালো হতো, আরও অনেক কিছু জানা যেত'।
প্রশিক্ষণার্থী লাবণী ঘোষ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, 'আমি সরকারি কুমুদিনী কলেজে অনার্সে অধ্যায়নরত। ভূঞাপুর উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে রুপচর্চার প্রশিক্ষণ নিয়ে অবন্তি লের্ডিস কর্ণার দিয়েছি। মেয়েরা এখানে এসে রুপচর্চা করে যাচ্ছেন এবং আমি বিয়ের জন্য বাসা-বাড়িতে কনে সাজিয়ে থাকি। এতে করে প্রতিমাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আমার উপার্জন হচ্ছে। এ কাজ করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে সংসারের জন্য কিছু করতে পারছি'।
প্রশিক্ষণার্থী হ্যাপি আকন্দ ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, 'আমি কলেজে পড়াশোনা করছি। পরিবার অনেক সময় লেখাপড়ার খরচ চালাতে হিমশিমে পড়ে যায়। তাই রুপচর্চার এই প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে স্বাবলমী করার ক্ষেত্রে খুব সহজ হবে। এটির মাধ্যমে আমি যেকোনো পার্লারে কাজ করতে পারবো বা নিজেও একটি পার্লার দিতে পারব। এতে নিজের কর্মসংস্থান তো হবেই আরো অনেকে নারীরাও স্বাবলম্বী হবে। কারো মুখোপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না'।
প্রশিক্ষক নুসরাত জাহান ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, 'নিজেও এখান থেকে বিউটিফিকেশনের উপর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। এখন আমি নিজেই প্রশিক্ষক। আমার দেখা অনেকেই এখান থেকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন। অনেকেই হোম পার্লারে কাজ করছেন'।
প্রশিক্ষক সাদিকুন নাহার প্রিমা ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, 'বিউটিশিয়ান প্রশিক্ষণে রূপচর্চা সংশিষ্ট উপকরণ সম্পর্কে যেমন ফেসিয়াল, ব্লিচ, ম্যানিকিউর, পেডিকিউর, চুল কাটা, ভ্রু প্লাক, মুখ ম্যাসেজ, হেয়ার স্টাইল, বৌ সাজানো ইত্যাদি কাজে দক্ষতার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। তারা এই প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাবলম্বী হতে পারবেন। যেকোনো অনুষ্ঠানে তারা সাজানোর কাজ করতে পারবেন। তবে প্রশিক্ষণটির মেয়াদ বাড়ানো হলে অনেক কিছু জানতে পারতো তারা'।
এ বিষয়ে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা কনিকা মল্লিক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, 'জাপানি সংস্থা জাইকার সহায়তায় নারীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ১২ দিনের বিউটিশিয়ানের প্রশিক্ষণ হয়েছে। এতে প্রশিক্ষণার্থীরা সনদের পাশাপাশি সম্মানী ভাতা পেয়েছেন। এ ছাড়াও এই প্রশিক্ষণ গ্রহণে নারীরা কর্মসংস্থানের পাশাপাশি স্বাবলম্বী হতে পারবেন'।
কেএফ/