সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণ: হাজার কোটি টাকার ক্ষতি, দায়ভার কার
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হাজার কোটি টাকার রপ্তানি পণ্যের দায় নেবে কে এ প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। রপ্তানিকারকরা ক্রেতাদের কাছে সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে না পারলে ভবিষ্যতে অর্ডার হারানোর ঝুঁকি আছে।
পুড়ে যাওয়া পণ্য বিশেষ করে তৈরি পোশাকগুলো ডিপো থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজবোঝাই করা অবস্থায় ছিল। চলতি মাসেই এসব পণ্য বিদেশি ক্রেতাদের হাতে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সময়মতো পণ্য পৌঁছানো ভেস্তে গেছে। পাশাপাশি রপ্তানিকারকরা পড়েছেন বিপুল ক্ষতির মুখে। কনটেইনার ডিপো মালিকদের গাফিলতির কারণেই দেশের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা পথে বসার উপক্রম হয়েছে এ অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহলে। দাহ্য বিপজ্জনক পদার্থ নিয়ম মেনে রাখলে হয়তো এত বড় ক্ষতি হতো না বলে মনে করছেন তারা।
বিজিএমইএ'র প্রথম সহ সভাপতি এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের দায়িত্বশীল সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনার কারণে এত বড় ক্ষতি হলো ব্যবসায়ীদের। যা পুষিয়ে উঠতে কষ্টকর হবে। তবে আমরা এই মুহূর্তে কাউকে দায়ী না করে দেশের ইমেজ সংকট হচ্ছে কিনা তা নিয়েই চিন্তিত। কারণ বিদেশি ক্রেতারা কীভাবে বিষয়টি দেখবেন তা নিয়েই ভাবছি। আমরা চাই দেশের ইমেজ ক্ষুন্ন না হোক।
ক্ষতি কী পরিমাণ হয়েছে এ প্রশ্নে তিনি বলেন, হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে আমরা ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণের জন্য ডাটা কালেকশন করছি। এরপর হয়তো বলা যাবে ক্ষতির পরিমাণ কত।
বিজিএমইএ’র সহ সভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই দায়ভার কারো না কারো ওপর পড়বে। তবে আমরা তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারো ওপর দোষ দিতে চাচ্ছি না। আমরা এখন জোর দিচ্ছি ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়। কীভাবে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে আবার পণ্য রপ্তানি করা যায়।
ব্যবসায়ীদের কী পরিমাণ ক্ষতি হলো এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ক্ষতি অনেক হয়েছে। এক কথায় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হলো। সবচেয়ে বড় বিষয় যেসব প্রতিষ্ঠানে এসব রপ্তানি পণ্য তৈরি হয়েছে সেখানকার শ্রমিকদের বেতনের সাথে বোনাসও দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি পোশাকখাতের ব্যবসায়ীদের বিশেষ করে রপ্তানি পণ্য পুড়েছে এমন মালিকদের জন্য বিপর্যয়ের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে এক হাজার কোটি থেকে ১২শ’ কোটি টাকার পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন গার্মেন্টস মালিকরা। ক্ষতির বিষয়টি এখনো নিরুপণের পর্যায়ে আছে। গার্মেন্টস পণ্য ছাড়া বিএম কনটেইনারে রপ্তানিযোগ্য পণ্যবাহী আরও বিপুল কনটেইনার আছে। যেসব কনটেইনার ভর্তি মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সোমবার দুপুর পর্যন্ত কনটেইনারগুলোতে জ্বলেছে আগুন। কোনো কনটেইনার আর অক্ষত পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন গার্মেন্টস মালিকরা। বিপুল পরিমাণ রপ্তানি পণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন কারখানার আমদানিকৃত বহু কাঁচামালও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ডিপোতে থাকা পণ্যভর্তি দেড় হাজারেরও বেশি কনটেইনারের ৯৫ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শুধু পণ্য নয় মূল্যবান এসব কনটেইনারগুলো আর কখনো পণ্য ভর্তি করার উপযোগী করা যাবে না এমনটি মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
বিএম কনটেইনার ডিপোর মালিক চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গ্রুপ স্মার্ট গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। হল্যান্ডের সাথে যৌথ বিনিয়োগে ২০১১ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে। প্রায় ২৫ একর জায়গার ওপর গড়ে তোলা বেসরকারি এই কনটেইনার ডিপোর ধারণক্ষমতা ৭ হাজার কনটেইনার (প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২০ ফুট)। এর মধ্যে শনিবার ও রবিবারের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সময় এই ডিপোতে ৪ হাজার ৩শ’ কনটেইনার ছিল। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ছিল খালি কনটেইনার। ১ হাজার ৩শ’ টি কনটেইনার ছিল পণ্য ভর্তি।
সংশ্লিষ্টদের অনেকেই চট্টগ্রামের বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলোর অবকাঠামোসহ নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা বলছেন, দ্রুততার সাথে গড়ে ওঠা এসব কনটেইনার ডিপোগুলোর অনেকগুলোতে কড়া তদারকি নেই। নিয়মিত মনিটরিং করা হয় না নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এতে আমদানি ও রপ্তানি পণ্যগুলো ঝুঁকির মধ্যে থাকে।
চট্টগ্রাম বন্দরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, ২৫ বছর আগে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর কার্যক্রম শুরু হয়। এসব কনটেইনার ডিপো প্রাইভেট আইসিডি হিসেবে পরিচিত। উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডের ওপর চাপ কমানোর পাশাপাশি রপ্তানি ও আমদানি পণ্যের হ্যান্ডেল আরও সহজ করা। বিভিন্ন কারখানায় উৎপাদিত রপ্তানি পণ্য ট্রাক এবং কাভার্ডভ্যানে বোঝাই করে এখানে আনা হয়। পরে এখানে কনটেইনারে বোঝাই করে জাহাজিকরণের মাধ্যমে রপ্তানি করা হয়। দেশের শতভাগ রপ্তানি পণ্য এই প্রক্রিয়ায় জাহাজিকরণ করা হয়।
তিনি আরও জানান, বিএম কনটেইনার ডিপোসহ চট্টগ্রামে ১৬টি বেসরকারি আইসিডি রয়েছে। এসব ডিপোতে শতভাগ রপ্তানি পণ্যের পাশাপাশি ৩৭ ধরনের আমদানি পণ্য বোঝাই কনটেইনার এনে খালাস করা হয়। এতে কনটেইনার ডিপোতে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, কনটেইনার মুভারের চলাচল থাকে সবসময়। বেসরকারি ডিপো ভিত্তিক বড় একটি শিল্পও গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামে। এসব ডিপোতে শত শত কর্মী কাজ করেন। যারা পরোক্ষভাবে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের সাথে যুক্ত।
এসজি/