হাওরে বাঁধ রক্ষায় রাত জেগে পাহারা
রাতে ঘুম নেই সিলেট ও সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃষকদের। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বৃদ্ধি পেয়েছে নদীর পানি। পানির প্রবল চাপে প্রতিদিনই ভাঙছে এক একটি ফসল রক্ষা বাঁধ। তলিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের সোনালী ফসল। যে কয়টি বাঁধ এখনও ঠিকে আছে তাও ভেঙ্গে যাবার আশঙ্কা স্থানীয় কৃষকদের। অকাল বন্যার কবল থেকে নিজেদের কষ্টার্জিত ফসল হারিয়ে হাওর পাড়ে বইছে কান্নার রোল। হাওর রক্ষায় মাইকে ঘোষণা দিয়ে রাতে কাজে নেমেছেন স্থানীয়রা। সুনামগঞ্জের কয়েকটি হাওরের ফসল একেবারেই তলিয়ে গেছে। আবার তলিয়ে যাবার আশঙ্কায় অনেকেই জমি থেকে কাঁচা ধান কেটে নিয়ে আসছেন। একই অবস্থা সিলেটেও। সিলেটের নিম্নাঞ্চলের কয়েকটি হাওরে পানি ঢুকতে শুরু করেছে।
সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় বছরের একমাত্র ফসল বোর ধানই সেখানকার কৃষকদের জীবন ধারণের অবলম্বন। সোমবার (৪ এপ্রিল) শাল্লার বোর ধানের খলারবন ও বাঘারবন নামক দুটি ছোট হাওরে দারাইন নদীর পানি ঢুকে তলিয়ে যায় ৬টি গ্রামের অন্তত পাঁচ শতাধিক কৃষকের বোরোধান। এতে দামপুর, খল্লি, চব্বিশা, রূপসা, মনুয়া ও সহদেবপাশা গ্রামের পাঁচ শতাধিক কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানান এলাকাবাসী।
কৃষকদের অভিযোগ, ওই হাওরে বাঁধ রক্ষায় কোনো প্রকল্প হাতে নেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে প্রতি বছরই অরক্ষিত অবস্থায় থাকে ওই হাওরের প্রায় ৩০০ একর বোরো জমি। অন্যদিকে নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং উপচে হাওর প্রবেশ করায় আতঙ্কিত রয়েছেন হাজারো কৃষক।
অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে উপজেলা সদর সংলগ্ন কইয়ার হাওর, পুট্টিয়ার হাওর ও গোবরহরি হাওরও। এই ৩টি হাওরে কয়েক হাজার একর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, এসব হাওরে জমির পরিমাণ কম বলে ফসল রক্ষা বাঁধের বাইরে রাখা হয়। কিন্তু এসব হাওরের ফসলি জমির উপর ভরসা করে থাকে হাজারো কৃষক। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধ তৈরি করে ফসল রক্ষার চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে হাওর বাঁচাও আন্দোলন উপজেলা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক তরুণ কান্তি দাস বলেন, মাদারিয়া বাঁধে ১৪ লাখ টাকার বরাদ্দ না দিয়ে সুখলাইন ও রঘুনাথপুর গ্রামের মধ্যে বাঁধ দিলে গোবরহরি হাওরটি সুরক্ষিত থাকত। ওই হাওরে ঘুঙ্গিয়ারগাঁও, রঘুনাথপুর ও যাত্রাপুর গ্রামের শতশত কৃষকের জমি রয়েছে। শাল্লা সরকারি ডিগ্রি কলেজের পূর্বদিকে একটি বাঁধ দিলে কইয়ারবন ও পুট্টিয়ারবন হাওরটি রক্ষা করা যেত। এখানে লুটতরাজ চলছে বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য পাউবো’র শাখা কর্মকার্তা আব্দুল কাইয়ুমের মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকার্তা আবু তালেব বলেন, পুটিয়া, রঘুনাথপুর, মোহনখল্লি, মনুয়া আমাদের এলাইনমেন্টের বাইরে (হাওরের বর্ধিতাংশের বাইরে)। এরপরও যেহেতু এখানে কিছু ফসল আছে আমি কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করেছি। যাতে তারা স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কাটে। আমরাও সহযোগিতা করছি। দাড়াইন নদীর পানি বেড়ে গেছে। পানির ধাক্কায় কিছু পানি মনুয়ার দিকে ঢুকছে বলে জানান তিনি।
সুনামগঞ্জর বোরো ধানের স্বর্গরাজ্য খ্যাত তাহিরপুর। তবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এই উপজেলার ৮১টি গ্রামের মানুষের ফসল পানিতে তলিয়ে যায়। এ ছাড়াও অন্যান্য বেড়ি বাঁধের কাজও ঠিকমতো হয়নি। ফলে ভারতের চেরাপূঞ্জিতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় শনিবার (২ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০টায় উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের নজরখালীর বেড়ি বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ঘটনা ঘটে।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জয়পুর, গোলাবাড়ি, মন্দিয়াতা, রংচি, রূপনগরসহ বিভিন্ন গ্রামের কৃষকরা। বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় টাংগুয়ার হাওরের প্রায় ৩ হাজার একর জমির ফসল ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে প্রশাসন বলেছে, শনিবার ২৫ হেক্টর জমির ধান তলিয়ে গেছে।
এদিকে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের বরাম হাওরের তোফানখালী বাঁধে ফাটল ধরার খবর পাওয়া গেছে। বর্তমানে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে এই বাঁধটি। পিআইসি নম্বর ৮৫ ও ৮৬ আওতায় এই ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজারটি হাওর অংশে ফাটল ও গর্ত সৃষ্টি করেছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
এ বিষয়ে দিরাই পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী এটি এম মোনায়েম হোসেন বলেছেন, উপজেলার ৮টি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। তুফানখালী বাঁধে ফাটল ধরেছে। আমি উর্ধতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করেছি। বাঁধ রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন বাঁধেও দেখা দিয়েছে ফাটল। বাঁধ রক্ষায় উপজেলার বিভিন্ন মসজিদে মসজিদে মাইকিং করা হচ্ছে। এই আহ্বানে ফসলহানির শঙ্কায় ভেঙ্গে পড়েছেন কৃষকরা। যার যা কিছু আছে তা নিয়ে রাতের আধারেই বাঁধ রক্ষায় কাজ করছেন শতাধিক কৃষকরা।
এ ছাড়াও উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া, শালদিকা, বেদাখালি ও ছাতলীর বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। সোমবার (৪ এপ্রিল) রাতে মাইকে ভেসে আসা বাঁধ রক্ষার আহ্বানে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। রাতের ঘুম হারাম হয়ে পড়েছে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের। এ যেন মরার উপর খড়ার ঘা। তাই রাতের আধারেই যে যার মতো করে ছুটছেন বাঁধ রক্ষায়।
বাঁধে ফাটল দেয়ার খবর শুনেই বাঁধ পরিদর্শন করেছেন শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনোয়ার উজ জামান ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান প্রভাষক নূর হোসেন।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, টাংগুয়ার হাওরের ভেতরে ১২০ হেক্টর জমিতে ধান চাষ হয়েছিল। তিন-চার বছরে কোনো বন্যা না হওয়ায় স্থানীয় কৃষকরা এই জমিগুলোতে ধান চাষ করেন। নজরখালী বাঁধ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন নয়। স্থানীয় কৃষকরা প্রতিবছর নিজেদের অর্থায়নে এই বাঁধ নির্মাণ করেন। এবার তাদের দাবির প্রেক্ষিতে ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পানির প্রথম ধাক্কাটা মোকাবেলা করতে পারলে এই হাওরের ধান ১৫-১৬ দিনের মধ্যে পেকে যেত। সেই লক্ষমাত্রা সামনে রেখেই বাঁধটি নির্মাণ করা হয়। কিন্তু গেল কয়েকদিনে ভারতের চেরাপূঞ্জিতে ৫৪৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে যাদুকাটা নদী ও পাহাড়ি ছড়া দিয়ে প্রবল বেগে পানি চলে আসে। এতে আমাদের নদীগুলোতে প্রায় ৪.৪ মিটার পানি বেড়ে যায়। এ কারণে এই পানির চাপ এই বাঁধ মোকাবেলা করতে পারেনি। তবে অন্যান্য বাঁধের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা হলেও কোনো ঝুঁকি নেই। বৃষ্টিপাত না হলে নদীর পানি কমে যাবে।
তা ছাড়াও সোমবার (৪ এপ্রিল) সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার কয়েকটি হাওরে নদীর পানি প্রবেশের খবর পাওয়া গেছে। উপজেলার পূর্ব জাফলং, পশ্চিম জাফলং রুস্তুমপুর তোয়াকুল ও ডৌবাড়ী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার হাওরাঞ্চলের বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানির চাপে হুমকির মুখে পড়েছে উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বোরো ফসল। চোখের সামনে ফসল হারোনোর শঙ্কায় দিন কাটছে কৃষকদের। দুশ্চিন্তায় ভুগছেন কৃষানীরাও। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে স্থানীয় কৃষকরা।
এ ব্যাপারে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রায়হান পারভেজ জানান, ডুবে যাওয়া ধানের জমি ও এলাকা পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে কাজ করছি। পরিদর্শন শেষে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানাতে পারব। তবে তিনি জানান, উপজেলার পূর্ব জাফলং, পশ্চিম জাফলং, রুস্তুমপুর ও ডৌবাড়ী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের বোরো ফসলের জমি বর্তমানে পানির নিচে আছে।
এসআইএইচ