রংপুরে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট
মাটি পরীক্ষা করে জমি চাষাবাদের সুবিধা কাজে লাগাতে পারছেন না কৃষক
রংপুরে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় গবেষণাগারে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে ফসলের উৎপাদন খরচ শতকরা ১৫-২৫ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। পাশাপাশি মাটির প্রয়োজনীয় উপাদান নিশ্চিত করে ফলন বৃদ্ধির মাধ্যমে অধিক লাভবান হওয়া যায়। রংপুর অঞ্চলে কৃষদের উৎসাহিত না করায় ও তাদের মাঝে এ বিষয়ে বিস্তারিত সচেতনতা জানা না থাকায় সুবিধা কাজে লাগাতে পারছেন না এ অঞ্চলের চাষীরা। সরকারিভাবে রংপুরে মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় গবেষণাগারে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে সুযোগ রয়েছে মাটি পরীক্ষার। রংপুর অঞ্চলের যে মাটিতে বছরের পর বছর চাষাবাদ হয়ে আসছে সে মাটির স্বাস্থ্যে সুরক্ষার খবর জানেন না অধিকাংশ কৃষক। বছরের পর বছর মাত্রানুযায়ী নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম জমিতে দেয়া হচ্ছে, কিন্তু মাটি পরীক্ষার পর দেখা যায়, ফসফেট ও পটাশের মাত্রা অনেক বেশি, আবার উপাদানের মাত্রা বেশ কম। অধিকাংশ কৃষক ফসল অনুযায়ী জমিতে প্রয়োজনীয় মাত্রায় সার ব্যবহার করছেন কিন্তু মাটি পরীক্ষার বেশকিছু সারের অপব্যবহার ধরা পড়ে। ফলে রংপুরে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় গবেষণাগারে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে ফসলের উৎপাদন এ অঞ্চলের কৃষকরা এর সুফল পাচ্ছে না।
রংপুরের কৃষি অধিদপ্তরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, রংপুরে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় গবেষণাগারে আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে মাটি পরীক্ষা করে ফসলের উৎপাদন এ অঞ্চলের কৃষকরা এর সুফল পাচ্ছে না। তাদের কৃষকদের উৎসাহ ও পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি। তিনি আরো বলেন, গত দু’বছর আগে কৃষি দপ্তর থেকে প্রায় ২ হাজার কৃষকের জমির মাটি পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল আজ অবদি রিপোর্ট অফিসে আসেনি।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার চর গনাই গ্রামের কৃষক মো. মানিকমিয়া ২৫ বছরের বেশি সময় কৃষিকাজ করছেন। কখনো তিনি জমির মাটি পরীক্ষা করাননি। আগে জমিতে তিনটি ফসল আবাদ করলেও এখন তার ১৫ বিঘা জমিতে শুধু বোরো ও আমন ধান, মরিচ, মিস্টি কুমড়া, মরিচ আবাদ করেন। তিনি জানান, দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে জমিতে সার প্রয়োগ করেন। প্রতি মৌসুমে জমির ফসল নানা রোগে আক্রান্ত হয়। লক্ষণ দেখে এবং কৃষি বিভাগের পরামর্শে ব্যবস্থা নেন। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে জমিতে প্রয়োজনীয় উপাদান রক্ষাসহ উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব বিষয়টি উল্লেখ করলে তিনি বলেন, বিষয়টি জানা নেই। কোথায় মাটি পরীক্ষা হয়, শুধু তিনি নন তার এলাকায় অনেক কৃষকই জানেন না। তিনি দাবি করেন, স্থানীয় কৃষি অফিসের মাধ্যমে যদি জমির মাটি পরীক্ষা করানো যেত, তাহলে কৃষক উপকৃত হতেন। কারণ কৃষি কর্মকর্তা কমবেশি তাদের জমিতে এসে চাষাবাদ সম্পর্কে বিভিন্ন পরামর্শ দেন।
লালমনিরহাট জেলার সদর উপজেলার গোকুন্ডা ইউনিয়েনের পাঙ্গা টারী গ্রামের কৃষক মো. পিন্টু মিয়া জানান, বাপ-দাদার পর এখন তারা আট ভাই পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ১২৮ বিঘা জমিতে কৃষিকাজ করছি। কখনো মাটি পরীক্ষা করার কথা শুনিনি। জমিতে প্রতি বছর তিন ফসল পাট, আমন ধান ও ভুট্টা চাষ করে থাকি। ভৌগোলিক কারণে তাদের ইউনিয়ন নদী দ্বারা উপজেলার সঙ্গে বিভক্ত। এলাকা বাসীর জীবনযাপন বেশ কষ্টকর। তাই মাটি পরীক্ষার বিষয়টি যদি কৃষি বিভাগের মাধ্যমে করা হয় তাহলে প্রত্যন্ত এলাকার কৃষকরা কৃষির উপর সচেতন হবেন।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মাহবুব রহমান বলেছেন, রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী ও রংপুরে মোট ফসলি জমির পরিমাণ ১৬ লাখ ৯৮ হাজার ৬৯ হেক্টর। এ জমিতে রংপুর আঞ্চলের বিভিন্ন শ্রেনীর চাষীদের জমি চাষাবাদের উপর কৃষি নির্ভরশীল অর্থনীতি।
জানাগেছে, রংপুর নগরীর লালবাগে অবস্থিত মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট বিভাগীয় গবেষণাগারটি সাজানো হয়েছে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে। মাটির বিভিন্ন উপাদান যেমন ফসফরাস, সালফার, বোরন পরীক্ষার জন্য রয়েছে স্পেকট্রোমিটার। মাটির অম্লমান নির্ণয়ে আছে পিএইচ মিটার, পটাশিয়াম নির্ণয়ের আছে ফ্রেম ফটোমিটার। জিঙ্ক, কপার আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেশিয়াম নির্ণয়ে আছে পটাশিয়াম অ্যাটোমিক অ্যাবজর্পশন স্পেকট্রোমিটার। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা হচ্ছে মাটির অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান জৈব পদার্থ ও নাইট্রোজেন।
মাটি গবেষণাগার মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের রংপুরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আইয়ুব-উর-রহমান বলেছেন, কৃষকের মাঝে এখনো মাটি পরীক্ষার তেমন উৎসাহ দেখা যায় না। মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত নির্দেশনা মোতাবেক জমিতে সার, কীটনাশক, পানি ও অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করলে উৎপাদন খরচ শতকরা ১৫-২৫ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম সার প্রয়োগ করলে জমির স্বাস্থ্য ভালো থাকে। রংপুর বিভাগের শুধু দিনাজপুরে মাটি পরীক্ষা হতো। এখন গত ডিসেম্বর-২১ থেকে রংপুরে সারের পাশাপাশি মাটি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কৃষকের মাঝে মাটি পরীক্ষার আগ্রহ সৃষ্টির জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। কোনো জমির মাটি একবার পরীক্ষা করলে মোটামুটি তিন বছর আর পরীক্ষা করা লাগবে না। রংপুর অঞ্চলের মাটি অম্লীয়। অতিরিক্ত অম্লতা দূর করতে না পারলে জমিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফসল উৎপাদন কমে যাবে। এজন্য মাটি পরীক্ষা করে চাষাবাদ করলে কৃষক উপকৃত হবেন।