একাধিক বাঁধে ফাটল, ঘুম নেই হাওরবাসীর
রাত সাড়ে ১২টা। তাহিরপুরের নজরখালি বাঁধের পাশে বসে আছেন শাহেদ আলী, নিবারণসহ ছয় কৃষক। ঘুম নেই কারো চোখে। কখন জানি স্বপ্নের সোনালী ফসল তলিয়ে যায়।
ভেঙে যাওয়া বাঁধ এর আগে কোনো রকমে মেরামত করার চেষ্টা চালানো হয়েছে। তবুও আশঙ্কা! এ অবস্থা শুধু তাহিরপুরের নিবারণ কিংবা শাহেদের নয়। সুনামগঞ্জ জেলার অধিকাংশ বাঁধে ফাটল দেখা দেওয়ায় এভাবেই রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন কৃষকরা।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি ও অতিবৃষ্টির ফলে নজরখালি বাঁধ ভেঙে টাংগুয়ার হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে। এরপর শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর, ভরাম হাওর, টাংনীর হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। সব হাওর কমবেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এরই মধ্যে বাড়ছে নদ-নদীর পানিও। বাঁধের ফাটল দ্রুত বন্ধ করা না হলে হাওরের ফসল যেকোনো সময় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় সুনামগঞ্জের কৃষকরা তাদের একমাত্র ইরি-বোরো ফসল নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
জেলার বাঁধ নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানিয়েছেন, মেঘালয় থেকে পানি নেমে আসায় নদ-নদীর পানি বেড়েছে। নজরখালি বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকেছে। অন্য হাওরগুলো এখনো ভালো আছে। জেলার সব ইউএনওকে হাওরের বাঁধের প্রতি সার্বক্ষণিক নজরদারির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যেসব বাঁধে এরই মধ্যে ফাটল দেখা দিয়েছে, সেগুলো দ্রুত ভরাট করে বাঁধকে শক্তিশালী করা হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত শনিবার (২ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাংগুয়ার হাওরের নজরখালি বাঁধ ভেঙে হাওরের প্রায় ১০০ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বলছে, নজরখালি বাঁধটি ফসল রক্ষার বাঁধ নয়। সেখানকার গ্রামবাসীর অনুরোধে বাঁধটি নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছিল। ৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধটি নদীতে পানির তীব্রতার আগেই ভেঙে যাওয়ায় কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার ফলে টাংগুয়ার হাওরসহ সংলগ্ন কয়েকটি ছোট ছোট হাওরের অন্তত ৪ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান কবির জানান, পানি প্রবেশ করায় নদীর পানির চাপ কমবে। অন্য হাওরের দিকে আর যাবে না। মাটিয়ান হাওর, শনির হাওরসহ সবকটি বাঁধের দিকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। ফসল রক্ষার জন্যে তারা দিনরাত কাজ করছেন।
দিরাই উপজেলার সর্ববৃহৎ ভরাম হাওরের তুফানখালী বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। কেবল ফাটলই নয়, বাঁধের কিছু অংশ দেবে গেছে। রবিবার (৩ এপ্রিল) উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুর আলম চৌধুরীসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা বাঁধটি পরিদর্শন করেন। বাঁধের ফাটল সংস্কারে কাজও শুরু হয়েছে। তুফানখালি বাঁধটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত। বাঁধটি কয়েকবার ভেঙে ভরাম হাওরে পানি ঢুকেছিল বলে স্থানীয় কৃষকরা জানিয়েছেন। একই উপজেলার কুলঞ্জ ইউনিয়নের টাংগুয়ার হাওর উপপ্রকল্পের মিলনগঞ্জ বাজারের অদূরে বাঁধটির একটি অংশে ধস দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাঁধের ধসে পড়া জায়গার ছবি ছড়িয়ে পড়েছে।
দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদুর রহমান মামুন জানান, পাউবোর ঊর্ধ্বতন প্রকৌশলীরা বাঁধটি সরেজমিনে এসে দেখে গেছেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী হেমারিং করা হচ্ছে। পিআইসির প্রতি ভরসা না করে বাঁধ রক্ষায় আমরা নিজেরাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছি। এ ছাড়াও জায়গামতো বাঁধ নির্মাণ না করায় শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরের কোনারবন্দ, জুয়ারিয়া, কৈয়ারবন্দ ও পুটিয়ারবন্দের প্রায় ৯০০ একর জমির ফসল অকাল বন্যার ঝুঁকিতে পড়েছে। ওইসব ছোট ছোট হাওরে উপজেলার রঘুনাথপুর, ঘুঙ্গিয়ারগাঁও, সুখলাইন, কলাকান্দি, কান্দিখলা, ডুমরা, উজান ও ভাটি যাত্রাপুরের প্রায় ৪ হাজার কৃষক জমি চাষ করেছেন। ওই এলাকার জমির ফসল রক্ষায় দাড়াইন নদীর তীরবর্তী রঘুনাথপুর সারিগাছা ও কৈয়াবন্দ ভাঙনে ২ বছর আগেও পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু গেল ২ বছর এ ভাঙনের জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করেনি পাউবো। পাউবোর খামখেয়ালিপনায় ওই এলাকার ফসল নিয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শতভাগ সম্পন্নের কথা ছিল। কিন্তু শতভাগ কাজ শেষ না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ের পর আরও ১০ দিন বাড়িয়েও কোনো কাজ হয়নি। বাঁধের কাজের টাকা দিতে প্রায় একমাস দেরি করে পাউবো। টাকা দেরিতে দেওয়ায় কাজও অনেক দেরিতে সম্পন্ন হয়েছে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। এর ফলে অনেক বাঁধ এখনো দুর্বল অবস্থায় রয়েছে। সময় মতো টাকা দেওয়া সম্ভব হলে গেল বছরের মতো এবারও বাঁধ শক্ত হতো বলে একাধিক পিআইসির লোকজন জানান।
পাউবোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জেলার বৃহৎ ৩৬টিসহ মোট ১৫৪টি হাওরের ফসল রক্ষায় ৫২০ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করছে পাউবো। ৭২২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসির মাধ্যমে জেলার ১১টি উপজেলায় বাঁধের কাজ শুরু হয়। এজন্যে প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ চাওয়া হয় ১২২ কোটি টাকা।
এসএন