নৌকায় জন্ম-নৌকায় জীবন-নৌকায় মৃত্যু
আজ এ ঘাটে, কাল ও ঘাটে জোয়ারভাটার ছন্দে চলে জীবন। জন্মের পর থেকেই নৌকায় বেড়ে ওঠা। নৌকাতেই হয় বিয়ে এবং সংসার। মৃত্যুও হয় নৌকায়। বলছিলাম মানতা সম্প্রদায়ের কথা। যুগ যুগ ধরে মুসলিম এই সম্প্রদায়ের লোকেরা নৌকায় বসবাস ও নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। সম্বল বলতে একটি কাঠের নৌকা ছাড়া আর কিছুই নেই।
মৃত্যুর পরে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া কিংবা নদীর কিনারায় পুঁতে ফেলা হয় মানতা সম্প্রদায়ের লোকদের। নদীতে ভাসমান এই মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বুড়াগৌরাঙ্গ, দাড়চিরা ও তেঁতুলিয়াসহ কয়েকটি নদীতে বসবাস করে আসছেন। এ উপজেলার নদ-নদীতে প্রায় দুই শতাধিক ‘মানতা’ পরিবার থাকলেও অনেকের ভোটার আইডি কার্ড হয়নি। শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এসব মানুষ। সমাজ-সভ্যতা থেকে ছিটকে পড়া এই জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি কয়েক যুগেও।
জানা গেছে, প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে নতুন জীবন শুরু করে নৌকায়। কাঠের তৈরি নৌকায় ভেসে জীবিকার সন্ধানে ছুটে আসে বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী বুড়াগৌরাঙ্গ, দাড়চিরা ও তেঁতুলিয়া নদীতে। পরে নৌকাতেই তাদের বংশবিস্তার ঘটতে থাকে। এ প্রজন্মের যারা আছেন তাদের অনেকেরই জন্ম হয়েছে নৌকায়।
'মানতা' সম্পদয় বিয়েও করেছেন নৌকাতেই। নৌকা নিয়ে সারাদিন নদীতে মাছ শিকার করাই এদের কাজ। কাজের সঙ্গে সঙ্গে রান্না করে নৌকাতেই খাবার খান। যদিও বর্ষার সময়ের চিত্র একটু ভিন্ন। নদী উত্তাল থাকায় দুপুরে কাজের সঙ্গে সঙ্গে রান্না করা সম্ভব হয় না। তাই সারাদিন কাজ শেষে সন্ধ্যায় নদীর কিনারায় নোঙর করেন। এরপরে রান্না করে একসঙ্গে রাতে খাবার খেতে হয়। যুগ যুগ ধরে এভাবে জীবনযাপন করে আসছেন তারা।
'মানতা' সম্প্রদায়ের লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোট্ট একটি নৌকায় মা-বাবা ও সন্তানসহ সবাই একসঙ্গে বসবাস করেন। বিয়ের পরে সন্তানদের নৌকা আলাদা করা হয়। এ জনগোষ্ঠীর ছেলে মেয়েদের বিয়েও হয় এক নৌকা থেকে আরেক নৌকায়। সমাজ-সভ্যতা থেকে পিছিয়ে থাকায় মূল জনগোষ্ঠীর লোকেরা তাদের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধন করেন না।
মো. রিয়াজ, বাচ্চু ও কালু সরদার বলেন, আমরা নৌকায় থাহি। লেহাপড়া কী জিনিস বুঝি না। আমাগো পোলা-মাইয়া (ছেলে-মেয়ে) স্কুলে পড়াইতে চাই। কিন্তু সুযোগ অয়না (হয় না)। আমাগো জীবনে ডাক্তার দেহাই নাই। জ্বর অইলে এমনে এমনে ভালো অইয়া যায়। অনেকে অসুখে মইরা গ্যাছে। ডাক্তার-কবিরাজ কী জিনিস বুঝি নাই। এ্যাহন আমরা ভালো কইরা বাঁচতে চাই। গুরাগারা (ছেলে-মেয়ে) মানুষ করতে চাই।
এ ব্যাপারে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, মানতা সম্প্রদায়ের লোকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে এদের বাসস্থান হিসেবে নদীর কিনারায় ২৯টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ২৯ পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবার জন্য জমি এবং ঘর বরাদ্দ করা হবে। তারা যাতে চিকিৎসা, শিক্ষাসহ মৌলিক অধিকার পায়, সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এমএসপি