সাতক্ষীরার উত্তর সখিপুর এখন বালা তৈরির গ্রাম
সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার উত্তর সখিপুর গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বালা (রুলি) তৈরির কারখানা। এই কাজ করে গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই এখন সচ্ছল। গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই পাকা দালান। বাড়ির সাথেই রয়েছে ছোট কারখানা। সকাল হলেই খট খট শব্দে মেতে ওঠে পুরো গ্রাম। যে যার মতো কাজে ব্যস্ত।
নিজ বাড়ির উঠানে কিংবা বাড়ি সংলগ্ন ছোট কারখানায় চলে কর্মযজ্ঞ। কেউ পিতলের পাত গরম করছেন আবার কেউ সেটি মাপ অনুযায়ী কেটে জোড়া দিয়ে লম্বা পাইপে পরিণত করছেন, কেউ তৈরি করা পাইপে গালা ভরছেন, কেউ গালা ভরা পাইপ পিটিয়ে গোলাকার বালায় (রুলি) রূপ দিচ্ছেন। কেউ গোলাকার বালা থেকে গালা বের করে বালার দুই মুখ জোড়া দিচ্ছেন। কেউ সেই বালায় আবার গালা ভরছেন আবার কেউ সেই বালায় সেনি দিয়ে টুক টুক করে পিটিয়ে খোদাই করে নকশাঁ করছেন। এভাবেই কয়েক হাত ঘুরে প্রস্তুত হয় বালা। ঘরে ঘরে বালা তৈরির এই কর্মযজ্ঞ চলায় উত্তর সখিপুর গ্রামটিই এখন বালা গ্রাম নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
তবে এখানকার কারিগরদের ভালো সুনাম রয়েছে বালার উপর নান্দনিক সব ডিজাইন তৈরির কারণে। সম্পূর্ণ হাতে তৈরি এসব ডিজাইন করা বালার চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। প্রতি মাসে এই গ্রামের দুই শতাধিক পরিবারে প্রায় অর্ধ কোটি টাকার বালা তৈরি করা হয়। পরে উৎপাদিত এই সমস্ত বালা প্রাথমিকভাবে যায় ঢাকা, যশোর, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি বড় বড় জেলা শহরে। সেখানে হাতে তৈরি খোদাই করা এসব বালায় রঙ পালিশ করা হয়। তারপর তা চলে যায় সারাদেশে।
বালা তৈরির এই কর্মযজ্ঞে শামিল হওয়ায় গ্রামটি থেকে দূর হয়েছে বেকারত্ব। সেই সাথে নিজ বাড়িতে কাজ করতে পারার সুবাদে অনেক পরিবারের গৃহিনীরাও যুক্ত হয়েছেন এই কাজে। এতে পরিবারের সচ্ছলতা ফিরেছে তাদের।
উত্তর সখিপুর গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগে গ্রামের এক যুবক ঢাকায় একটি বালা তৈরির কারখানায় কাজ করতেন। সেখান থেকে গ্রামে ফিরে এলাকার কয়েকজন বেকার যুবক ও নারীদের এই বালা তৈরির কাজ শেখায় সে। ভালো দাম ও চাহিদা থাকায় এর পর একে একে গ্রামের সবাই এই কাজের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে আমাদের গ্রামের শতাধিক ছোট ছোট কারখানায় প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে তিন হাজার জোড়া বালা তৈরি হয়।
তিনি আরও বলেন, আমি প্রতিদিন ৮-১০ জোড়া বালায় নকশাঁ করতে পারি। প্রতি জোড়ার জন্য ৬০ টাকা করে মজুরি পাওয়া যায়। বাড়িতে বসেই কাজটি করতে পারায় ঘের-বাড়ির পাশাপাশি বালা তৈরির কাজ শিখেছি।
একই গ্রামের জিয়ারুল ইসলাম বলেন, ডিজাইন ভেদে মজুরিরও ভিন্নতা আছে। সাধারণ ডিজাইনের জন্য ৬০ টাকা জোড়া মজুরি পাওয়া যায়। ইরানি গোলাপসহ কিছু আলাদা ডিজাইন আছে সেগুলোর জন্য ১৮০ টাকা মজুরি পাওয়া যায়। এ ছাড়াও গালা ভরা, পাইপ বানানো ইত্যাদির জন্য প্রতি জোড়ায় ১৩ টাকা করে মজুরি পাওয়া যায়। গড়ে প্রত্যেক কারিগর দিনে ৬০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করতে পারে বলে জানান তিনি।
একই গ্রামের সাইফুল সরদার বলেন, আগে মাছের ব্যবসা করতাম। করোনার সময় বাড়িতে বসে না থেকে বালা তৈরির কাজ শিখেছিলাম। আমার স্ত্রীও এই কাজ করে। বর্তমানে আমরা দুইজন মিলে দৈনিক ৩০ থেকে ৪০ জোড়া বালা তৈরি করি। এতে দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হয় আমাদের।
বালা তৈরির কারিগর ইয়াকুব হোসেন বলেন, স্বর্ণের দাম অনেকের নাগালের বাইরে। তাই বালা তৈরির কাজে কখনো ভাটা পড়ে না। সবসময় আমরা কাজ করতে পারি। এমনকি শুক্র-শনিবার বলে কোনো কথা নেই। প্রতিদিনই কাজ করেন সকলে।
সখিপুর গ্রামের আশরাফুল ইসলাম আগে নিজে ডিজাইনের কাজ করলেও এখন নিজের কাজের পাশাপাশি নিজেই কাঁচামাল কিনে অন্যদের কাজ দেন।
তিনি বলেন, একেকটি বালা প্রস্তুতের জন্য কয়েক ধাপের কাজ করতে হয়। প্রস্তুত করা বালার জোড়া আকৃতি ভেদে ১২৫ থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। পরে এসব বালার রঙ পালিশ করে আরও বেশি দামে বিক্রি করেন পাইকাররা। তখন খুচরা বাজারে এসব বালার দাম ২০৫ টাকা জোড়া থেকে হাজার-বারোশ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়।
আশরাফুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আগে আমরা রঙ পালিশ করেই বিক্রি করতাম। তখন লাভ আরও বেশি ছিল। কিন্তু সাতক্ষীরা সীমান্ত জেলা হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে বিজিবি এগুলো ভারতীয় বলে হয়রানি করত। আটকে দিত। তাই এখন রঙ পালিশ ছাড়াই বিক্রি করা হয়। এ ছাড়াও বর্তমানে কাঁচামালের দাম একটু বাড়তি। কিন্তু প্রস্তুত করা বালার দাম বাড়েনি। এজন্য লাভ একটু কম হচ্ছে।
তিনি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, পেশাটি বেকারত্ব দূর করার জন্য অত্যন্ত সহায়ক। এজন্য বিদ্যমান সংকটগুলো কাটিয়ে সর্বত্রে এই কাজ ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সাতক্ষীরার উপব্যবস্থাপক গোলাম সাকলাইন বলেন, তারা আগ্রহী হলে বিসিকের পক্ষ থেকে তাদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও ঋণ দেওয়া হবে। পাশাপাশি হয়রানি রোধে তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের লাইসেন্স প্রদান করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এসআইএইচ