চুইঝালের চাহিদা বাড়ছে খুলনাসহ সারাদেশে
বর্তমানে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে চুইঝাল। মাংসে বাড়তি স্বাদ যোগ করে দেয় এই উপকরণটি। চুইঝালের সঙ্গে আস্ত রসুন দিয়ে গরু, খাসি কিংবা হাঁসের মাংস রান্না খুলনা অঞ্চলের ঐতিহ্য। এর প্রচলনও দীর্ঘদিনের। দেশের অন্যান্য এলাকায়ও এখন চুইয়ের জনপ্রিয়তা প্রসার লাভ করেছে। অনেকেই তরকারিতেও চুইঝাল ব্যবহার করছেন। নিরামিষভোজীরাও তাদের খাবার তালিকায় চুইঝাল রাখছেন। স্বাদ ও ঘ্রাণ বাড়াতে হালিম, ঝালমুড়িতেও ব্যবহার হচ্ছে চুইঝাল।
চুইঝাল দিয়ে রান্না করা গরু কিংবা খাসির মাংসের জন্য খুলনা শহর ও শহরের বাইরের কয়েকটি রেস্তোরা বা হোটেল ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারের আব্বাসের হোটেলটি। তাই দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই খাবারের স্বাদ নিতে খুলনার এসব রেস্তোরায় বা হোটেলে ছুটে আসছেন ভোজন রসিকরা। খুলনার জিরোপয়েন্ট, সোনাডাঙ্গার পর এখন ঢাকায়ও এর প্রসার লাভ করেছে।
কৃষিবিদরা বলছেন, চুই গাছ দেখতে অনেকটা পানের লতার মতো। এর পাতায় ঝাল নেই। এর শিকড়, কাণ্ড বা লতা কেটে টুকরো করে রান্নায় ব্যবহার করা হয়। রান্নার পর কিছুটা গলে যাওয়া চুইয়ের টুকরো চুষে বা চিবিয়ে খাওয়া হয়। এর স্বাদে ঝাল। তবে ঝালটা খুব তীব্র নয়, ঝাল ঝাল ভাব। এই ভাবটাই স্বাদটাকে আরও বেশি রসময় করে তোলে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, খুলনা বিভাগে চুই এত জনপ্রিয় যে একে খুলনার কৃষিপণ্য হিসেবে ব্র্যান্ডিং করার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। লাগানোর এক বছর পরই চুই থেকে আয় আসে। আবাদ লাভজনক হওয়ায় খুলনার বিভিন্ন গ্রামের পাশাপাশি যশোর, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাতে ব্যক্তিগত ও বাণিজ্যিক দুইভাবেই এর চাষ বাড়ছে। ঘেরের আইলেও চুইয়ের চাষ করছেন কেউ কেউ। ২ থেকে ৩ শতক জমিতে চুই লাগালে ৩ থেকে ৪ বছরের মধ্যে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় সম্ভব।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে খুলনার পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা ও রূপসা উপজেলায় চুইয়ের চারা উৎপাদন হয়। গড়ে উঠেছে ছোট-বড় নার্সারি। তিন মাসের মধ্যেই চুই চারা বিক্রি শুরু করা যায়। একেকটি চারা তৈরিতে খরচ হয় ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১০ টাকা। আর বিক্রি হয় ৩৫ থেকে ৪৫ টাকায়। এক বিঘা জমিতে লাগানো যায় ৬২০টি চারা। হাজার পঞ্চাশেক টাকা খরচ করলে একজন চাষি দেড় লাখ টাকার মতো চারা বিক্রি করতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার বান্ধা এলাকার অশোক বৈরাগী জানান, ২০১২ সালের দিকে তিনিই প্রথম এ অঞ্চলে চুইগাছের ডগা কেটে মাটিতে লাগিয়ে বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদনে সফল হন। এরপর স্থানীয় কৃষি বিভাগের সহায়তায় তার চারা উৎপাদনের পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়। এখন প্রতি বছর চুইয়ের চারা ও চুই বিক্রি করে ৬-৭ লাখ টাকা আয় করছেন।
তিনি আরও বলেন, চুই সাধারণত ২ ধরনের হয়। ধরণ দুটি হচ্ছে ঝাড়চুই এবং গেছোচুই। চুইয়ের কাটিং যেকোনো হালকা উঁচু বা গাছের গোড়ায় রোপণ করা যায়। উঁচু জায়গায় চুইগাছ ভালো হয়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ও আশ্বিন-কার্তিকই চুইলতা লাগানোর উপযুক্ত সময়।
একই উপজেলার আটলিয়া ইউনিয়নের বরাতিয়া গ্রামের নবদ্বীপ মল্লিক জানান, ২০১৬ সাল থেকে চুই নার্সারি করছেন তিনি। প্রতি বছর চুইয়ের চারা ও চুই বিক্রি করে ২০ লাখ টাকা আয় করছেন।
খুলনার কয়েকটি বাজারে দেখা গেছে, প্রতি কেজি চুই মানভেদে ৩০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ঈদের বাজারে এই দাম ২ হাজার টাকাও ছাড়িয়ে যায়। তবে মাটির নিচের অংশের শিকড় চুইয়ের দাম সবচেয়ে বেশি। এরপর কাণ্ড, ডাল এসবও ভালো দামে বিক্রি হয়।
খুলনা নগরীর গল্লামারি কাঁচাবাজারে প্রায় ৩৫ বছর ধরে চুই বিক্রি করেন শুকুর আলী বিশ্বাস। চুই ব্যবসায়ী শুকুর জানান, রংপুর, কুড়িগ্রামের পাইকার ছাড়াও খুলনার ডুমুরিয়া, যশোরের কেশবপুর, মনিরামপুর, ও বাগেরহাটের ফকিরহাট এলাকার চাষি-গৃহস্থদের কাছ থেকে চুই কিনে তিনি তার দোকানে বিক্রি করেন। আগের থেকে চুয়ের চাহিদা চারগুণ বেড়েছে।
আরেক চুই ব্যবসায়ী আব্দুল গফফার বলেন, আগের থেকে চুইয়ের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। চাহিদা বাড়ায় অনলাইনেও এখন চুইঝাল বিক্রি করছেন কেউ কেউ।
নগরীর দৌলতপুর কাঁচাবাজারে প্রায় ৪০ বছর ধরে চুই বিক্রি করেন আবদুর শেখ। তিনি জানান, রংপুর, কুড়িগ্রামের পাইকারদের কাছ থেকে চুই কিনে বিক্রি করেন তিনি। বর্তমানে চুইয়ের চাহিদা আগের চেয়ে বেড়েছে।
এ ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খুলনার উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, চুই বর্তমানে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য। ওষধিগুণ থাকায় এর চাহিদা ও ব্যবহার বেড়েই চলছে। সৃষ্টি হচ্ছে এর বাজার। চুইলতার চারা উৎপাদন বাণিজ্যেও বেশ সাড়া জাগিয়েছে। বিভিন্ন গ্রামে গড়ে উঠছে ছোট-বড় নার্সারি।
হাফিজুর আরও বলেন, খুলনার ডুমুরিয়া ও বটিয়াঘাটা উপজেলাতে ৬০ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হচ্ছে। বিভাগের ৪ জেলায় খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইলে মোট ১১০ হেক্টর জমিতে চুইয়ের চাষ হচ্ছে। এর মোট উৎপাদন প্রায় ১৯০ মেট্রিক টন। ৩ হাজার ৫৭০ জন কৃষক এসব জেলাতে চুইচাষের সঙ্গে যুক্ত।
এসআইএইচ