কিশোরগঞ্জ শত্রু মুক্ত হয়েছিল ১৭ ডিসেম্বর
মহান বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ বর্ণনায় উঠে আসে সেই ৭১ এর ভয়াবহ সময়ের কথা। বিজয়ের মাস এলেই আবেগাপ্লুত হয়ে উঠে মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীনতার পেছনের গল্পে রয়ে যায় না বলা কতশত স্মৃতি। মুক্তির সংগ্রামে ৯মাস রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয় ১৬ই ডিসেম্বর।বিজয়ের আনন্দে সারা বাংলাদেশ ভাসলেও ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের আনন্দ ছিলো না কিশোরগঞ্জবাসীর মাঝে। সেদিনও কিশোরগঞ্জবাসীর মনে আতংক তৈরি করেছিল আলবদর রাজাকারেরা।
১৬ ডিসেম্বরের রাত শহরবাসীর কেটেছিল নির্ঘুমে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার বদলে কিশোরগঞ্জের আকাশে উড়ছিল পাকিস্থানের পতাকা। ১৯৭১ সালের ২৫মার্চ ঢাকায় আক্রমণের পরে সর্বপ্রথম ১৯ এপ্রিল বিকেলে সশস্ত্র পাক হানাদার বাহিনী কিশোরগঞ্জে এসেছিল। ১৯৭১ সনের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলেও সেইদিন বিজয়ের আনন্দ পায়নি কিশোরগঞ্জ বাসী।
কিশোরগঞ্জ শহর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর মাওলানা আতাহার আলী, মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন, অধ্যাপক মাহতাব উদ্দীন এর নেতৃত্বে কিশোরগঞ্জে ছিল রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের শক্ত ঘাঁটি। সশস্ত্র পাক হানাদার বাহিনী ৪ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ ছেড়ে চলে গেলেও শহরে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে অবস্থান নেয় স্বাধীনতা বিরোধী আলবদর বাহিনী। ১৪ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কিশোরগঞ্জ সদর থানাকে চারদিক থেকে ঘিরে রাখেন।
কিশোরগঞ্জকে শত্রু মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে রাজাকার বাহিনী বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পনের প্রস্তাব করে। অধ্যাপক জিয়া উদ্দিন আহমেদ ও আজিম উদ্দিন হাই স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার খবর পাঠায় রাজাকার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা কবীর উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে কিশোরগঞ্জ শহরের চারপাশ ঘিরে ফেলে শক্ত অবস্থান নেয় মুক্তিযোদ্ধারা।
শহরকে শত্রুমুক্ত করতে ১৬ ডিসেম্বর রাতে চারদিক থেকে গেরিলা মুক্তিসেনারা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টেন চৌহানের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী প্রচন্ড গুলি বর্ষন করলে হানাদার বাহিনীর দোসররা কম্পিত হয়ে ওঠে। সেদিন রাতে কয়েকজন রাজাকারের মৃত্যু হয়। গভীর রাতে মুক্তিযুদ্ধের কোম্পানি কমান্ডার কবীর উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা প্লাটুন কমান্ডার দিলীপ সরকার, ড. মাসুদুল কাদের সহ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল করিমগঞ্জ থেকে কিশোরগঞ্জ শহরের নিকটে সতাল এলাকায় এসে অবস্থান নেয়।
১৭ ডিসেম্বর সকালে একটি খোলা জিপে করে কবির উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল প্রথম কিশোরগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। অন্য একটি দল মানিক,হান্নান মোল্লা, কামালের নেতৃত্বে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল দিয়ে কিশোরগঞ্জ প্রবেশের সময় কামালিয়ারচর ও খিলপাড়া এলাকায় পাকিস্তানি দোসরদের বাধার সম্মুখীন হয়। বাধা অতিক্রম করে সেই মুক্তিবাহিনীর দল কিশোরগঞ্জে প্রবেশ করে।
বিভিন্ন দিক থেকে মুক্তিসেনারা ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন চৌহানের নেতৃত্বে মিত্রবাহিনীও কিশোরগঞ্জে প্রবেশ করে। শহরের পুরান থানা শহীদী মসজিদ সংলগ্ন ইসলামিয়া ছাত্রাবাস মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদর বাহিনী। কিশোরগঞ্জের আকাশে বাতাসে সেদিন প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো জয় বাংলার স্লোগান উড়েছিল লাল সবুজের পতাকা।এভাবেই ১৭ই ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জ শহর শত্রু মুক্ত হয়েছিল।
এএজেড