'কয়ডা দিন আগে বস্তা ফালাইলে আমার বাড়ী নদীতে যাইত না'
আমার শেষ সম্বল চাইর ডিসিমেল জাগা, আর কিছু আছিল না। আমার পুলায় তিন বছর খাইটা এই জমিতে ইটু-ইটু কইরা থাকার ঘর দিছিল। সর্বনাশা মা গঙ্গা আমাগো এমনে সর্বনাশ করল আমরা এখন কনে যাইয়া খারামু। ঘরের চাল-বেড়া খুলাইয়া মাইনসের জমিতে নিয়া রাখছি। এখন ভাঙ্গা ঠেকাইতে সরকার বালির বস্তা ফালাইতাছে আর কয়ডা দিন আগে ফালাইলে আমার বাড়ী নদীতে যাইত না, শেষ রক্ষা হইত। কত চেয়ারম্যান মেম্বারগো কইছি তারা পারল না। আমি এখন ভিটা মাটি হারা। মাইনেসের বাড়ি আশ্রয় নিয়া থাকি-কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে এমনই বলছিলেন ইছামতি পাড়ের বাসিন্দা ষাট বছর বয়সী আয়না বিবি।
শেষ সময়ের আকস্মিক ভাঙ্গনে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায় ইছামতি নদী পাড়ের এমন প্রায় ত্রিশটি বাড়ি নদী গর্ভে হারিয়ে গেছে। সেইসাথে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী ঘিওর গরু হাটের একাংশ বিলীন হয়েছে। হুমকির মুখে রয়েছে হাটসংলগ্ন সেতু, দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শতাধিক বসতবাড়িসহ কয়েক শত বিঘা ফসলি জমি।
জানা গেছে, বসতবাড়ির ব্যাপক ভাঙনে ৩০টি পরিবার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবারকে আর্থিক সহায়তার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে জনপ্রতিনিধিরা লিখিতভাবে জানিয়েছেন।
স্থানীয় ঘিওর হাটের ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলায় যমুনা নদীতে পানি বাড়ায় এর শাখা নদী ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদীতে এক সপ্তাহ ধরে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ধলেশ্বরী ও ইছামতি নদীর পাড়ে শতাধিক বছরের পুরাতন ঘিওর হাট-বাজারসহ বসতবাড়ি, সেতু, কালভার্ট এবং অসংখ্য বসতবাড়ি রয়েছে।
ইছামতি ও ধলেশ্বরী নদীর তীব্র স্রোতের কারণে গেল দেড় সপ্তাহ ধরে দুই তীরে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়। এতে কুস্তা এলাকায় ঘিওর হাটের বেশ কিছু অংশ (গরু হাট), অন্তত ৩০টি বসতবাড়ি ও কৃষিজমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
এছাড়া কুস্তা এলাকায় কফিল উদ্দিন দর্জি উচ্চবিদ্যালয়, কুস্তার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইছামতি নদীর ওপর সেতু, কুস্তা কবরস্থান, আল আকসা জামে মসজিদ ও শ্মশান ভাঙনের কবলে পড়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙনরোধে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা না নিলে অচিরেই এসব প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে কয়েকটি পরিবার বাড়িঘর নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছে।
ঘিওর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অহিদুল ইসলাম বলেন, ঘিওর হাটের পাশে কুস্তা এলাকায় আধা কিলোমিটারের মধ্যে বসতবাড়ি ব্যাপক ভাঙনে ৩০টি পরিবার মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবারকে আর্থিক সহায়তার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
ওই ইউপি চেয়ারম্যান ও স্থানীয়রা জানান, ইছামতি নদীতে পানি বাড়ায় নদীতেও প্রচণ্ড স্রোত বইছে। স্রোতের তোড়ে গরুর হাট অর্ধেক নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের আশঙ্কায় নদীপাড়ের অবশিষ্ট দোকানপাটের মালামাল অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন দোকানিরা। পাকা স্থাপনাও ভেঙে নিচ্ছেন মালিকরা। নদীর পশ্চিম পাশে কুস্তা ও রসুলপুর গ্রামে বেশ কয়েকটি বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনকবলিত পরিবারগুলো হতাশায় রয়েছে। আতঙ্কে রয়েছেন ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা পরিবারগুলোর সদস্যরা।
ঘিওর হাট-বাজার ব্যবসায়ী ব্যবস্থাপনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল মতিন মুসা জানান, ইছামতি নদীর ভাঙনে এখন জেলার গুরুত্বপূর্ণ এই হাট-বাজারের বেশকিছু অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা না গেলে আগামীতে পুরো হাট-বাজারই নদীতে বিলীন হওয়ার আশংকার কথা জানান তিনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হামিদুর রহমান বলেন, ঘিওর হাট-বাজার ভাঙনরোধে ভাঙন এলাকায় বালুভর্তি জিওব্যাগ ফেলার কাজ শুরু করা হয়েছে। এছাড়া এই হাট-বাজার ভাঙনরোধে এবং আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পাওয়ার পর প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাবে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাঈন উদ্দিন বলেন, বসত বাড়ি এবং হাট-বাজারে ভাঙনরোধে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে ভাঙনকবলিত স্থানে বালুভর্তি ৮ হাজার জিওব্যাগ ফেলা শুরু হয়েছে।
এএজেড