টাঙ্গাইলে এক বছরে আলোচিত ১৪ ঘটনায় ১৭ খুন, ৮১ মামলা
টাঙ্গাইলে পরকীয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, দেনমোহর, যৌতুক, জমি নিয়ে বিরোধ, মাদক ব্যবসা, নির্বাচনী সহিংসতা ও পারিবারিক কলহের জেরসহ নানা কারণে গেল এক বছরে ১৪টি আলোচিত ঘটনায় ১৭ জন খুন হয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোর অধিকাংশের রহস্য উদঘাটন পূর্বক আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বাকিগুলোর তদন্ত চলমান রয়েছে।
টাঙ্গাইল পুলিশ অফিসের অপরাধ শাখা সূত্রে জানা যায়, টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার ১৩টি থানায় ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮১টি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
তারমধ্যে টাঙ্গাইল সদর থানায় ৯টি, দেলদুয়ারে ৭টি, গোপালপুরে ৩টি, ঘাটাইলে ১৫টি, মির্জাপুরে ১২টি, নাগরপুরে ৫টি, সখীপুরে ৭টি, বাসাইলে ৩টি, কালিহাতীতে ৯টি, ভূঞাপুরে ১টি, মধুপুরে ৬টি, ধনবাড়ীতে ২টি ও বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানায় ২টি মামলা রয়েছে।
এরমধ্যে ঘাটাইল থানায় সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৫টি মামলা এবং সবচেয়ে কম ভূঞাপুর থানায় ১টি হত্যাকাণ্ড মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাগুলো পরকীয়া, প্রেমে ব্যর্থতা, দেনমোহর, যৌতুক, জমির বিরোধ, মাদক ব্যবসা, নির্বাচনী সংঘর্ষ ও পারিবারিক কলহের জের ইত্যাদি কারণে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে মামলা দায়ের করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে দেনমোহর দেওয়ার ভয়ে গৃহবধূ নাজমাকে গত ১৭ ডিসেম্বর তার স্বামী ওয়াসিম হত্যা করে মির্জাপুরের একটি কলাবাগানে মাটি চাপা দিয়ে রাখেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মামলার রহস্য উদঘাটন ও অভিযুক্ত স্বামীকে গ্রেপ্তার করে।
ঘাটাইল উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের ভাবনদত্ত পণ্ডিত কাছড়া গ্রামে গত ২০ নভেম্বর রাতে স্ত্রী মিনারা আক্তারকে পারিবারিক কলহের জেরে হত্যার পর পুলিশকে ফোন দিয়ে লাশের পাশে বসেছিলেন স্বামী আমিনুল ইসলাম। স্ত্রীকে হত্যার পর স্বামী আমিনুল নিজেই থানায় ফোন করে বলেন, ‘আমার স্ত্রীকে আমি হত্যা করেছি। আপনারা এসে আমাকে নিয়ে যান’। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে আমিনুলকে গ্রেপ্তার করে। এ মামলাটির তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে'।
উপজেলার দিগড় ইউনিয়নের কাশতলা দক্ষিণ পাড়া গ্রামের সৌদি প্রবাসী জয়েন উদ্দিনের মা জমিলা বেগম (৬০), স্ত্রী সুমি বেগমকে (২৫) পরকীয়ার জেরে কুপিয়ে হত্যার পর প্রেমিক শাহ জামাল (৩০) আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। মামলাটির তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।
কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার শামছুল হক ডিগ্রি কলেজের পাশে একটি ভবনের সিঁড়িতে নবম শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া আক্তারকে (১৫) গলাকেটে হত্যা করে প্রেমিক মনির হোসেন। পরে নিজেও একই ছুরি দিয়ে গলাকেটে আত্মহত্যা করেন।
তাকে ছেড়ে অন্য এক ছেলের সাথে প্রেমে জড়ানোর কারণে প্রেমিকার গলাকেটে নিজেও আত্মহত্যা করেন ট্রাক চালকের সহকারী মনির হোসেন। ঘটনার আকস্মিকতা ও চাঞ্চল্য বিবেচনায় র্যাব-১২ এর সিপিসি-৩ টাঙ্গাইলের একটি চৌকষ টিম স্বপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করে ঘটনার ১০ ঘণ্টার মধ্যে রহস্য উদঘাটন করে।
মধুপুর উপজেলার কুড়াগাছা ইউনিয়নের গরম বাজার এলাকার একটি জলপাই গাছের পাশে গৃহবধূ ইয়াসমিন আক্তারকে পারিবারিক কলহের জেরে স্বামী নুরুন্নবী হত্যা করে। এ ঘটনায় পুলিশ ইয়াসমিন আক্তারের স্বামী নুরুন্নবীকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলা থানা পুলিশ তদন্ত করছে।
মির্জাপুর উপজেলার গোড়াই ইউনিয়নের পালপাড়ার কুরনীটেক এলাকার জনৈক নুর মোহাম্মদের জমি থেকে ২ অক্টোবর অজ্ঞাত এক কিশোরী গৃহকর্মীর (গৃহপরিচারিকা) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তার গায়ে গরম পানি ঢেলে নির্যাতনের পর নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। চিকিৎসকের পরীক্ষায় কিশোরীকে ধর্ষণের আলামতও পাওয়া যায়। বিষয়টি চাঞ্চল্যকর হলেও পুলিশ এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি। থানা পুলিশের বাদী হয়ে দায়েরকৃত মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে।
নানিবাড়ি থেকে বাড়ি ফেরার পথে নিখোঁজ গোপালপুর উপজেলার জয়নগর গ্রামের যুবতী খোদেজা খাতুনের বস্তাবন্দি লাশ গত ৩ আগস্ট ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়কে বীরভরুয়া নামকস্থান থেকে উদ্ধার করা হয়। প্রথমে পরিচয় না পাওয়ায় বেওয়ারিশ হিসেবে ভূঞাপুরের ছাব্বিশা সামাজিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। বিষয়টি জেলায় ব্যাপক আলোচিত হয়। ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে টাঙ্গাইলের পিবিআই স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলাটির দায়িত্ব নেয়।
পরে মোবাইল ফোনের পরিত্যক্ত একটি বাক্সের সূত্র ধরে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঘটনার পাঁচ দিনের মধ্যে রহস্য উদঘাটন করে। পরে খোদেজা খাতুনকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় জড়িত চার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায়। মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মগড়া ইউনিয়নে পারিবারিক কলহের জেরে গত ৩১ জুলাই বাবা আব্দুল কদ্দুসকে কুপিয়ে হত্যা করে তার ছেলে লুৎফর রহমান। পারিবারিক বিষয় নিয়ে বাকবিতণ্ডার এক পর্যায়ে লুৎফর রহমান ধারালো অস্ত্র দিয়ে বাবা আব্দুল কদ্দুসকে কুপিয়ে হত্যা করে। পুলিশ ছেলে লুৎফর রহমানকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছে। মামলাটির তদন্ত কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
কালিহাতী উপজেলার গোলড়া গ্রামে ঈদের দিন (১৫ মে) রাতে মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে শুকুর মিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। ওই সময় শুকুর মিয়ার বাম হাত কেটে নিয়ে তারা উল্লাস প্রদর্শন করে। এ মামলাটির তদন্ত চলছে।
কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার বাঁশি এলাকার কৃষক চান মিয়াকে পরকীয়ার জের ধরে স্ত্রী রাজিয়া বেগম ও তার প্রেমিক রডমিস্ত্রি আব্দুল হালিম ওরফে রিপন হত্যা করে বাড়ির সেপটিক ট্যাংকে লুকিয়ে রাখে।
গত ৬ এপ্রিল কৃষক চান মিয়ার অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গৃহবধূ রাজিয়া বেগম ও পরকীয়া প্রেমিক আব্দুল হালিম ওরফে রিপনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনার তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
টাঙ্গাইল জেলা কালচারাল অফিসার খন্দকার রেদওয়ানা ইসলাম প্রসব ব্যথা নিয়ে মির্জাপুর কুমুদিনী হাসপাতালে ভর্তির পর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। পারিবারিক কলহের জের ধরে তার ব্যাংকার স্বামী মিজানুর রহমান ওরফে দেলোয়ার গত ২৭ মার্চ খন্দকার রেদওয়ানা ইসলামকে হাসপাতালের কেবিনে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে- দ্রুতই আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার বাথুলী সাদি গ্রামে কাপড় তৈরির ব্যবসার হিসাব নিয়ে বিরোধের জেরে গত ১৪ মার্চ ছোট ভাই শফিকুল ইসলাম ছুরিকাঘাতে বড় ভাই আব্দুল মজিদকে খুন করেন। পুলিশ ছোটভাই শফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে জেল-হাজতে পাঠায়। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার বল্লা করোনেশন হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের এসএসসি পরীক্ষার্থী আশা আক্তারকে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মোবাইল ফোনে ডেকে ঘর থেকে বের করে কুপিয়ে হত্যা করে ফেলে রেখে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থীর মা ও কোকডহরা ইউনিয়নের দত্তগ্রামের প্রবাসী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী সুফিয়া বেগম বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে।
টাঙ্গাইলের গোপালপুর পৌরসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষে বলির পাঠা হিসেবে ক্ষুদে ব্যবসায়ী খলিল মিয়া খুন হন।
গত বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি দোকানে বিক্রির জন্য সুপারী কিনতে গিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষ চলাকালে মাঝখানে পড়ে দেশীয় অস্ত্রের এলোপাথারি আঘাতে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলাটির তদন্ত চলছে।
এ ছাড়া টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার দপ্তিয়র ইউনিয়নে গত ২৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের দুপক্ষের নির্বাচনী সংঘর্ষে নিহত তোতা শেখ, মধুপুর উপজেলার মহিষমারা গ্রামের বাগানবাড়ি চৌরাস্তায় গত ১০ অক্টোবর মাদকাসক্ত নাতি মঞ্জুর হোসেন নেশার টাকা না পেয়ে দাদি সেফাতন নেছা খানকে কুপিয়ে ও গলাকেটে হত্যা করে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার দাইন্যা ইউনিয়নের বাঘিল বাজার সংলগ্ন শ্রীফলিয়াটা গ্রামে পরকীয়ার জেরে ২২ মে একটি পুকুর ডুবিয়ে সহোদর আবিদা ও রিফাত নামে দুই শিশু হত্যা, সখীপুর উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাদিঘী গ্রামে ২৬ এপ্রিল রাতে পারিবারিক কলহে স্ত্রী হামিদা আক্তার তার স্বামী কিতাব আলীর গোপনাঙ্গে লাথি মেরে খুন, মির্জাপুর উপজেলার বাঁশতৈল ইউনিয়নের জুড়ান মার্কেট এলাকায় যৌতুক ও ননদের স্বামীর কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকা প্রবাসীর স্ত্রী সাদিয়া আক্তার হত্যা, মির্জাপুর উপজেলার বাইমহাটির যমুনা ক্লিনিকের সামনে ২৩ মার্চ ছুরি দিয়ে আলিমুল মোল্লা নামে এক যুবককে খুন, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মগড়া ইউনিয়নের আয়নাপুরের চরখিদির গ্রামে ২ মার্চ জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে প্রতিবেশী ভাবি আলেয়া বেগমের দায়ের আঘাতে দেবর আঞ্জু মিয়া খুন এবং ঘাটাইল উপজেলার মজমপুর গ্রামে জমি নিয়ে বিরোধের জের ধরে গত বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেশী প্রতিপক্ষের কুড়ালের আঘাতে কৃষক ইউসুফ আলী খুন ইত্যাদি ঘটনাগুলোও জেলায় আলোচিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে ব্যাপক প্রচারণায় আসে।
টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কায়সার জানান, 'চলমান মামলাগুলোর অধিকাংশেরই প্রতিবেদন ইতোমধ্যে আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। কিছু মামলার তদন্ত চলমান রয়েছে।'
তিনি আরও জানান, 'সামাজিক মূল্যবোধের অভাব ও স্বার্থের দ্বন্দ্বে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। প্রতিটি পরিবারে মানবিক শিক্ষা জোরদার করা হলে দেশে অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে।'
টিটি/