৭০ বছর পর কষ্টের কথা জানালেন রংপুরের ভাষাসৈনিক আফজাল
সারাদেশ যখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল সে সময় বসে ছিল না রংপুরের দামাল ছেলেরা। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে মিছিল-মিটিং সমাবেশ করে জানিয়েছে তীব্র প্রতিবাদ। তাদের একজন রংপুরে বাংলা ভাষা আন্দোলনের নিবেদিত প্রাণ মোহাম্মদ আফজাল। ইংরেজি ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের সঙ্গে প্রথম থেকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে তার রাজনীতির হাতেখড়ি। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের তিনি একজন। দীর্ঘদিন ছিলেন গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সভাপতি। একটানা দু‘বার রংপুর পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৫২’র রক্ত ঝরা দিনগুলো নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের কাছে স্মৃতিচারণ করেন রংপুরের ভাষাসৈনিক ও সংগঠক মোহাম্মদ আফজাল।
অতিতের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ১৯৪৭ সালে ছিলেন রংপুর জিলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা উর্দূ ঘোষণার পর থেকে ১৯৪৮ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিতে আসতেন রংপুরের ঐতিহ্যবাহী পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র মিছিলের ওপর গুলি বর্ষণের খবর রংপুরে সন্ধ্যার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাতেই মিছিল নিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। পুলিশের অবিরাম লাঠিচার্জে মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় সেই মিছিল। রংপুরের অনেক তরুণ ছাত্র সেদিন মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি কারমাইকেল কলেজে প্রতিবাদ সভা হয় এবং পুনরায় এক বিরাট মিছিল নিয়ে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এ মিছিলটিকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছিল পুলিশ। কিন্তু বাধা উপেক্ষা করে মিছিলটি সারা শহর প্রদক্ষিণ করে। এরপরে প্রতিদিনই কারমাইকেল কলেজে প্রতিবাদ সভা হতো বেরুতো মিছিল।
মোহাম্মদ আফজাল জানান, সে সময় তিনি মেট্রিক পরীক্ষার্থী হিসেবে জিলা স্কুল থেকে মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এরপর তিন দিন রংপুরে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। তিনি সব সময় মিছিলের সামনে থেকে বাংলা ভাষার আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি বলেন, রংপুরে ভাষা আন্দোলনের মূল বিরোধিতাকারী ছিলেন কারমাইকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ শাহাব উদ্দিন। ছাত্রদের মিছিল, সভা-সমাবেশ করতে দিতেন না। ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত কোথাও কোনো পোস্টার কিংবা দেয়াল লিখন দেখলেই পিয়নদের হুকুম দিয়ে ছিঁড়ে কিংবা মুছে ফেলাতেন। এমনকি ভাষা আন্দোলন করার অভিযোগে কলেজের দু’জন অধ্যাপককে গ্রেপ্তার করান তিনি এবং একজনের নামে জারি করান গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। এছাড়াও তিনি কলেজের কয়েকজন ছাত্রকে কলেজ থেকে বহিষ্কারের আদেশ দিয়ে নোটিস দেন এবং অনেকের জরিমানা করেন। এ বিষয়টি তিনি পত্র দিয়ে জানিয়ে দিতেন ছাত্রদের অভিভাবকদের।
সহযোদ্ধাদের স্মৃতিচারণ করে মোহাম্মদ আফজাল বলেন, ১৯৫২ সালে কারমাইকেল কলেজ হয়ে ওঠে রংপুরে সংঘটিত ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। আন্দোলনে তখন নেতৃত্ব দিতেন মতিউর রহমান, আলতাব হোসেন, মোহাম্মদ আফজাল, আজিজুর রহমান, সুফী মোতাহার হোসেন, তোফাজ্জল হোসেন, শাহ আবদুর রাজ্জাক, আশরাফ হোসেন বড়দা, শামসুল হুদা, শাহ আবদুল বারী, শাহ তবিবর রহমান প্রধানসহ আরও অনেকে।
১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে কারমাইকেল কলেজে প্রতিদিনই চলে সভা-সমাবেশ। ধীরে ধীরে এ প্রতিবাদী কর্মসূচি ছড়িয়ে যায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগ দিতে থাকেন সাধারণ মানুষ। একপর্যায়ে ৫২ পরবর্তী শহিদ দিবস উদযাপনে ১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঐক্যবদ্ধ তৎপরতায় এক রাতের শ্রমে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে কাদামাটি দিয়ে তৈরি হয় প্রথম শহিদ মিনার। রংপুরে প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণের দুঃসাহসিক রাতের স্মৃতি এখনো দোলা দেয় ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ আফজাল হেসেনের হৃদয়ে।
তিনি বলেন, রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠের মাঝখানে রাতের আঁধারে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের যৌথ উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের বীর শহিদদের স্মরণে স্মৃতির এই মিনার নির্মাণ করা হয়। সেই দিনটি ছিলো ১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। অসীম সাহস আর মনোবল নিয়ে সেদিন ছাত্র নেতারা নিজেরাই ইট-বালু, কাঁদা মাটি আর সিমেন্ট সংগ্রহ করেছিলেন। তাদের প্রচেষ্টায় রাতারাতি পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের হলরুমের ঠিক সামনে ছোট আকারে মাথা তুলে দাঁড়ায় শহিদ মিনার।
প্রবীণ এই ভাষাসৈনিক বলেন, ১৯৫২তে রংপুরে ভাষা আন্দোলন হলেও ৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভাষাসৈনিক তবিবর রহমানের বাড়িতে শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্দেশ্যে আমিনুল ইসলাম, খয়রুল ইসলাম, নজমুল আলম হেবিন, ছোট ভাই জেবিন, গোলাম রব্বানী বুলবুল, মকদুসার রহমান, সুফী মোতাহার হোসেন, আনিছুল হক পেয়ারাসহ আরও অনেকের উপস্থিতিতে আলোচনা সভা হয়। এতে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, যুবলীগ মিলে যৌথ কমিটি করে ওই দিন রাতেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে শুরু হয় তোড় জোড়। সে দিন রংপুর শহরের গুপ্তপাড়া নিউ ক্রস রোডের ডাক্তার মোজাহার হোসেনের বাড়ির সামনে থেকে কিছু ইট এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আরও ইট সংগ্রহ করা হয়। সিমেন্ট হিসেবে প্রথমে ব্যবহার করা হয় তৎকালীন রংপুর পৌরসভার পুকুরের কাদা মাটি। এভাবেই রাতের আঁধারে নির্মিত হয় রংপুরের প্রথম শহিদ মিনার।
তিনি আরও বলেন, শহিদ মিনার নির্মাণের বিষয়টি জানাজানি হলে পরদিন সূর্যোদয়ের আগেই পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে রংপুরের আপামর ছাত্র-জনতার জমায়েত হয়। ভোর বেলা অস্থায়ী সেই শহিদ মিনার ফুলে ফুলে ভরে যায়। সেদিন সবাই শহিদদের উদ্দেশে সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের শপথ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে রংপুরের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকদের উদ্যোগে ইটের গাঁথুনি দিয়ে একটি শহিদ মিনার নির্মিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত এটাই ছিল রংপুরের প্রথম কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হায়েনাদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময় শহিদ মিনার গুড়িয়ে দেয় পাক সেনারা। পরে সম্মুখযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭৭ সালে পূর্ণাঙ্গ শহিদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন পৌর পরিষদ। দেশের প্রখ্যাত স্থপতি রংপুরের পীরগঞ্জের টিআইএম নুরুন্নবী চৌধুরী ওরফে তাজু চৌধুরীর স্থাপত্য নকশা ও তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সালে বর্তমান শহিদ মিনারটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।
মোহাম্মদ আফজাল বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল, সেই আন্দোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ বপন করেছিল। ভাষা আন্দোলন সফল না হলে এত দ্রুত স্বাধীনতা পেতাম না।দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এখন দেশ স্বাধীন। স্বাধীনতার সূর্বণজয়ন্তী হয়েছে। দেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রচলন হয়নি। এখনো ইংরেজিতে বিচার বিভাগে রায় লেখা হয়, বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি লেখা সাইনবোর্ড ব্যবহার হয়। ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পরও এসব দেখা আমাদের জন্য কষ্টের।এখনো অনেক পরিবারের অভিভাবক ছেলে-মেয়ের বিয়ের কার্ড ইংরেজিতে ছাপান। কার্ডতো যাচ্ছে বাঙালিদের কাছে। বাংলা জানেন না এমন কতজনের কাছে কার্ড যাচ্ছে? এটা এক ধরনের হীনমন্যতা। এই হীনমন্যতা নিয়ে কোনো জাতি গড়ে উঠতে পারে না। বয়সের ভারে ধীরে ধীরে নুইয়ে পড়লেও সেই বায়ান্ন-একাত্তরের তেজোদীপ্ত মনোবল যেন এখনো রয়েছে তার। অবসরে বই, পত্রিকা পড়েন, টিভি দেখেন।ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে সংগ্রামী, নির্লোভ এই কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ এখনো চির কুমার। বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। রংপুর নগরীর মুন্সিপাড়ায় এখন নিজ বাড়িতে একা থাকেন। বার্ধক্যের কারণে শরীর ভেঙে পড়েছে। স্ত্রী-সন্তান না থাকায় নিকটত্মীয়রা তার তদারকি করেন।