গভর্নর হাউসকে বঙ্গবন্ধুর ‘উত্তরা গণভবন' নামকরণের ৫০ বছর
প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবনখ্যাত নাটোরের উত্তরা গণভবনের আগে নাম ছিল গভর্নর হাউস। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের পর ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আব্দুল মোনয়েম খান দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির নামকরণ করেন গভর্নর হাউস।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভর্নর হাউসের নাম পরিবর্তন করেন। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি তিনি এর নাম দেন ‘উত্তরা গণভবন’।
বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই নামকরণের ৫০ বছর পূর্তি হল বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি)। তবে ৫০ বছর পূর্তিতে গণভবনকে আলোকসজ্জা করা হলেও দিনটিকে স্মরণীয় করতে নেওয়া হয়নি বিশেষ কোনো কর্মসূচি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাটোরের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (নেজারত শাখা এবং ট্রেজারি শাখা) জুয়েল আহমেদ জানান, বঙ্গবন্ধুর 'উত্তরা গণভবন' নামকরণের ৫০ বছরপূর্তি উদযাপনে গত প্রায় সাড়ে চার মাস থেকে গণভবন চত্বরে লাগানো হয়েছে নানা ধরনের ফুলের চারা।
মোট ২২ ধরনের ২৮ হাজার মৌসুমী ফুলের চারা রোপন করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো জিনিয়া, ডায়ানঠাথ, ক্যালেন্ডুলা ও এন্টাহেনা।
এক প্রশ্নের জবাবে দিনটি উদযাপনে জেলার বিভিন্ন সরকারি অফিসের কর্মকর্তা ছাড়াও জেলার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে-এমন দাবি করেন তিনি।
নাটোরের ইতিহাস ও প্রবীন রাজনীতিকদের মতে, এই উত্তরা গণভবনকে ঘিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল অনেক পরিকল্পনা। এ গণভবনকে ঘিরে নাটোরকে উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দিয়েছিলেন নানা প্রতিশ্রুতিও।
জানা যায়, স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই নাটোরে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাজে আসতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে ছিল তার অনেক পছন্দের মানুষ। তাই নাটোর হয়ে উঠেছিল তার পছন্দ আর ভালো লাগার জায়গা। সঙ্গত কারণেই নাটোরসহ উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখতেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর এ কাজে তিনি নাটোরকে করতে চেয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র। যেন নাটোর হবে দেশের দ্বিতীয় রাজধানী। এ সংক্রান্ত মিটিংয়ও করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাঞ্চলীয় বাসভবনখ্যাত নাটোরের উত্তরা গণভবনে এ সংক্রান্ত প্রকাশ্য প্রতিশ্রুতিও দেন শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর পরিবার ও আওয়ামী লীগ যেভাবে শোকাহত হয়েছে, একইভাবে উন্নয়নবঞ্চিত হয়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল নাটোরে।
সেই শোক আজও ভুলতে পারেনি নাটোরের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী, তাদের পরিবারের সদস্যসহ নাটোরের আপামর জনগণ।
দীর্ঘদিন পর বঙ্গবন্ধুর দল ও কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে আবারও আশায় বুক বাঁধেন নাটোরের মানুষ।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নাটোরকে ঘিরে বাবার সেই স্বপ্ন ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন এমন আশায় আজও বুক বেঁধে আছে নাটোরের মানুষ।
নাটোরের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের দাবি, নাটোরকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন কর্মসূচি চিন্তা করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তিনি নাটোরে করতে চেয়েছিলেন পূর্ণাঙ্গ টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রতি বছর উত্তরা গণভবনে অন্তত একটি করে ক্যাবিনেট মিটিং করবেন। আর এর মাধ্যমে নাটোরসহ উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন সাধিত হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও নাটোর পৌর মেয়র উমা চৌধুরী জলি জানান, বঙ্গবন্ধুর কিছু প্রিয় মানুষ ছিল নাটোরে। তাদের টানে প্রায়ই ছুটে আসতেন বঙ্গবন্ধু। বাবা প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরীকে গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন তিনি। নাটোরে তার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন প্রয়াত এমপি সাইফুল ইসলাম, যুবলীগ নেতা মুজিবুর রহমান রেজা, ছাত্রলীগ নেতা মজিবর রহমান সেন্টু, আওয়ামী লীগ রমজান আলী প্রাং প্রমুখ। প্রায়ই তিনি নাটোরে মিটিং করার জন্য ছুটে আসতেন।
এ সময় তার সফরসঙ্গী হতেন জাতীয় চার নেতাসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। তারা নাটোর বোর্ডিংয়ের একটি রুমে আলোচনা করতেন। আলোচনা করতেন সারাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা। পরিকল্পনা করতেন নাটোরকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন কর্মসূচি।
স্বাধীনতার পরও উত্তারা গণভবনে এসে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে এ সংক্রান্ত মিটিং করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
একদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উমা চৌধুরী জলি জানান, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু আসেন উত্তরা গণভবনে। এ সময় তিনি তার বাবা প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরী সঙ্গে গিয়েছিলেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু তার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে একাকী হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা উপস্থিত হন উত্তরা গণভবনে।
এ সময় এক বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানান, নাটোর হবে উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র। এ সময় তিনি নাটোরে একটি পূর্ণাঙ্গ টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেন।
এর কয়েকদিন পরেই নাটোর হরিশপুর ওয়াপদা মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও বঙ্গবন্ধু নাটোরকে কেন্দ্র করে উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন নিয়ে নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নাটোরে পূর্ণাঙ্গ টিভি স্টেশনসহ উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র হতো নাটোর- এমন দাবি করেন উমা চৌধুরী জলি।
তৎকালীন জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, নাটোর এনএস কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি, মুক্তিযুদ্ধকালীন জেলা সংগ্রাম পরিষদের সিটি কনভেনার ও কলেজ সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি মুজিবুর রহমান সেন্টু জানান, ১৯৬৯ সালে নাটোর বোডিংয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে সভা করেন। এ সময় নাটোর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়েও তিনি খাবার খান।
১৯৭১ সালে জাতীর জনকের আগমনে গণভবনের তারা উপস্থিত ছিলেন দাবি করে জানান, নাটোরকে উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
এ সময় তিনি আরও ঘোষণা করেন, উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হবে নাটোর। এজন্য নাটোরে একটি পূর্ণাঙ্গ টিভি স্টেশন স্থাপনসহ সার্বিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু যা বলতেন তাই করতেন দাবি করে মুজিবুর রহমান সেন্টু জানান, জাতির জনক বেঁচে থাকলে নাটোর সত্যি সত্যি দেশের দ্বিতীয় রাজধানী হতো। তাকে অকাল মৃত্যুর মধ্য দিয়ে নাটোরবাসীকে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি আজও অপূর্ণই রয়ে গেল।
নাটোর ও নওগাঁ সংরক্ষিত আসনের এমপি রত্না আহমেদ দাবি করেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নাটোর হতো সমৃদ্ধ নগরী, দেশের দ্বিতীয় রাজধানী।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দুস্কৃতিকারীরা শুধু বঙ্গবন্ধু পরিবার ও আওয়ামী লীগের ক্ষতি করেনি বরং ক্ষতি করেছে নাটোরের অগ্রযাত্রা কেও।
আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর দলের আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। এমন সময়ে বঙ্গবন্ধুর ওয়াদা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন শেখ হাসিনা- এমন প্রত্যাশা করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও জানান, নাটোরের বিলচলন এবং অবকাঠামোসহ সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, উত্তরা গণভবনকে কেন্দ্র করে নাটোরকে পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলা এবং নাটোরকে কেন্দ্র করেই পুরো উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের চিন্তা ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়নের কাজ করছেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের নাটোর গড়তে ভূমিকা পালন করবেন শেখ হাসিনা -এমন আশাবাদ পূণব্যক্ত করেন তিনি।
তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা রমজান আলী প্রামাণিকের ছেলে নাটোর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ডের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম নান্টু জানান, তার বাবাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
তোফায়েল আহমেদ, কামরুজ্জামান, তার বাবা রমজান আলী, শংকর গোবিন্দ চৌধুরী ও স্থানীয় এমপি আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে সারা দেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন ও দেশের উন্নয়ন নিয়ে নিয়মিত মিটিং করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ জন্য তিনি প্রায়ই নাটোরে আসতেন।
শহরের বড়হরিশপুর ওয়াপ্দা মাঠে বঙ্গবন্ধু এ সংক্রান্ত দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রেখেছিলেন।
নাটোরকে উত্তরবঙ্গের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু।
তিনি তার বাবার কাছে শুনেছেন, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নাটোর হতো উন্নত নগরী। হতো দেশের দ্বিতীয় রাজধানী।
দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করে রফিকুল ইসলাম নান্টু আরও বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছেন। ইতোমধ্যেই নাটোরে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট হয়েছে।
দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে নিরলস কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ করে যাচ্ছেন। নাটোরকে কেন্দ্র করে পুরো উত্তরাঞ্চলের উন্নয়ন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে স্বপ্ন ছিল, বঙ্গবন্ধুর উত্তরা গণভবন নামকরণের ৫০ বছর পূর্তির সন্ধিক্ষণে সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পদক্ষেপ নিবেন শেখ হাসিনা- এমন প্রত্যাশা তার।
কেএম/এমএসপি