সরকারি আবাসনে থাকা পরিবারগুলোর মানবেতর জীবনযাপন
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গোরকমন্ডল এলাকায় ২০০২ সালে নির্মিত হয় সরকারি আবাসন প্রকল্প। এরপর সেখানে বসবাসের সুযোগ পান ২৫০ ভূমিহীন পরিবার। সরকারি আবাসনে পাঁচ থেকে ছয় বছর ২৫০ ভূমিহীন পরিবার তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে ভালোভাবে কাঁটান। এরপর আস্তে আস্তে সরকারি আবাসনটির ঘরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ে। সরকারিভাবে আবাসনটি সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়ায় চরম দুর্ভোগ সহ্য করতে না পাড়ায় গত ৫ বছরের মধ্যে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার সরকারি আবাসন ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যান। বর্তমানে আবাসনে থাকা ৫০ থেকে ৬০টি পরিবারের অন্য কোথাও বসবাসের সুযোগ না থাকায় পরিবার-পরিজন নিয়ে চরম দূর্ভোগের মধ্যে কষ্টের জীবনযাপন করছে।
গোরকমন্ডল আবাসন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের গোরকমন্ডল এলাকার ভূমিহীন ও গৃহহীন ছিন্নমূল পরিবারের জন্য ২০০২ সালে আবাসন, আশ্রয়ণ ও গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। খাত জমির ওপর থাকার ঘর নির্মাণ করে সুফলভোগীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য বহুমূখী প্রকল্প হাতে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও কিছুদিন পরে তা আর আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে বর্ষা মৌসুম না হলেও শীত মৌসুমে তীব্র ঠান্ডা ও হিমেল হাওয়া এবং শিশির বিন্দু ঘরে প্রবেশ করায় কষ্টের জীবন কাঁটছে সরকারি আবাসনে। আবাসনের প্রতিটি ঘরের চাল ও টিনের ব্যাড়ায় বড় বড় ছিদ্র হয়েছে। প্রতিটি রুমে বৃষ্টির পানির মতো শিশির বিন্দু পড়ে বিছানাপত্র ও আসবাবপত্রসহ প্রয়োজনীয় জিনিস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বর্ষাকালে এ দুর্ভোগ আরও বাড়ে।
প্রায় ১৮ থেকে ১৯ বছর আগে নির্মাণ করা এসব ঘর সংস্কার না করায় টিনের ছাউনি ফুটো হয়ে গেছে। ফলে সামন্য বৃষ্টি হলে ঘরের ভিতর পানি পড়ে। কেউ কেউ বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে টিনের ওপর পলিথিন দিয়ে রেখেছেন। প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি টিউবওয়েল ও একটি টয়লেট নির্মাণ করা হলেও সংস্কারের অভাবে তা ব্যবহারের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ পলিথিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে কাঁচা টয়লেট বানিয়ে তা ব্যবহার করছেন। ফলে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি হুমকির মুখে। শত কষ্টের পরেও এখানকার ভূমিহীন পরিবারগুলো দিনের পর দিন নিরুপায় হয়ে দিন কাটাঁচ্ছেন। যেন দেখার কেউ নেই। একই চিত্র উপজেলার চরগোরকমন্ডল, শিমুলবাড়ী, কাশিপুর ও ফুলবাড়ীর ফুলসাগড়ের আবাসনগুলো।
আবাসনে থাকা আছমা বেওয়া (৪৫) জানান, ৫ বছর আগে আমার স্বামী ১ মেয়ে ও ১ ছেলে রেখে মারা যান। অনেক কষ্টে মানুষের বাড়িতে কাজ-কাম করে দুই সন্তানকে মানুষ করেছি। অভাবের কারণে ছেলে-মেয়েকে পড়াশুনা করাতে পারিনি। কোন রকমেই মেয়েটার বিয়ে দিয়েছি। এখন ছোট ছেলেটাকে নিয়ে এই ভাঙ্গা আবাসনেই কোনো রকমে খেয়ে-না খেয়ে বেঁচে আছি। স্বামীর মারা যাওয়ার ৫ বছরও জোটেনি বিধবা ভাতা। ছেলেটা চায়ের দোকানে থেকে ১৫০ টাকা আয় করেন। আমিও মাঝেমধ্যে মানুষের বাড়িতে কাজ-কাম চলছে জোড়াতালির সংসার।
মন্টু বিশ্বাস (৬৫) ও দ্বিনেশ চন্দ্র রায় (৫৫) বলেন,আমাদের থাকার কোন জমিজমা নেই। তাই সরকারি ভাবে এই আবাসনে থাকার সুযোগ মেলে। আবাসনটি নির্মানের প্রায় ১৯ বছর হয়েছে। এখন কোন ভাবেই থাকার উপযোগী নয়। নেই টয়লেট ,টিউবওয়েল বেড়াচাটি সব কিছুই নষ্ট হয়েছে। গত ৫ থেকে ৭ বছরে অধিকাংশ পরিবার আবাসন থেকে চলে গেছে। আমাদের কোথাও কোন থাকার ব্যবস্থা না থাকায় পলিথিন দিয়ে শত কষ্টের মাঝেও এখানেই পড়ে আছি। আমরা সরকারের কাছে ভাঙ্গা চুড়া আবাসনটির সংস্কারের জন্য সরকারের কাছে জোড় দাবী জানাচ্ছি।
গোরকমন্ডল আবাসনের সভাপতি আব্দুল মোন্নাফ জানান, আজ থেকে ১০ বছর ধরে আবাসনটি সংস্কারের জন্য স্থানীয় চেয়ারম্যান-মেম্বার ও উপজেলা প্রশাসনের যোগযোগ করেছি। প্রতিশ্রুতি দিলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বর্তমানে আবাসনের ঘরগুলো অবস্থা খুবই খারাপ। প্রতিটি টিনের চাল ফুটো হয়েছে। টয়লেটের ঘরগুলোর টিনও পঁচে গেছে। বাধ্য হয়ে বৃষ্টি ও শীত থেকে রক্ষা পেতে কোনো রকমেই টিনের চালে পলিথিন ও পলিথিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে কাঁচা টয়লেট বানিয়ে তা ব্যবহার করছি। ফলে আমাদের আবাসনবাসী স্বাস্থ্য ঝুঁকি হুমকির মুখে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে গত ৫ থেকে ৬ বছর প্রায় দুই শতাধিক পরিবার চলে যান। আমরা সেই কাল থেকে আজও ৫০ থেকে ৬০ পরিবার জোড়াতালি দিয়ে কষ্টে জীবন পার করছি। তিনি দ্রুত এই আবাসনটি সংস্কারের জন্য সরকারের আকুল আবেদন জানিয়েছেন।
নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাছেন আলী জানান, আবাসনের অবস্থা খুবই খারাপ। অনেক কষ্টে পরিবারগুলো বসবাস করছে। এলজিডি ও ত্রাণ অফিসসহ উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবরে আবাসনটি সংস্কারের জন্য লিখিত আবেদন জানানো হবে।
ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুমন দাস জানান, আশ্রয়ন প্রকল্পগুলো যে সকল উপকারভোগী বসবাস করছেন তাদের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। ভবিষ্যতেও নিবেন। বরাদ্দ পাওয়ার সাথে যেগুলো দেখভাল করার দরকার সেগুলো আমরা দেখবো। কেউ যদি নিতান্তই খুব বিপর্যস্ত অবস্থায় থাকে তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমরা তাদের বিপর্যস্ত ও দুর্যোগ কাটিয়ে উঠার জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করব।
অসিআর/এসআইএইচ