ছাত্রলীগ নেতার পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে এসে কাউন্সিলর পুত্র আটক
ছাত্রলীগ নেতা মো. শহীদুজ্জামান বিল্পব ও আটক শামীম আহম্মেদ তুষার। ছবি: ঢাকাপ্রকাশ
চুয়াডাঙ্গায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্নাস চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষায় কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের প্রক্সি দেওয়ার অপরাধে এক ভুয়া পরীক্ষার্থীকে আটকের পর এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সোমবার (১ জুলাই) চুয়াডাঙ্গা সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজ কেন্দ্রে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওই পরীক্ষার্থীকে আটক করা হয়। টানা ৮দিন প্রক্সি দেওয়ার পর নবমতম পরীক্ষার দিনে জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে শনাক্ত হয় ওই ভুয়া পরীক্ষার্থী। অভিযোগ উঠেছে, কলেজ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলারও।
দণ্ডপ্রাপ্ত শামীম আহম্মেদ তুষার জীবননগর পৌর এলাকার ৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইসলামপুর গ্রামের মো. খোকনের পুত্র এবং যশোর ক্যান্টনমেন্ট কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অর্নাস তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনের অনার্স চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা গ্রহণের কেন্দ্র চুয়াডাঙ্গা সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজে। এই কেন্দ্রে চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। এ পরিক্ষায় অংশ নেয় চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও জীবননগর ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শহীদুজ্জামান। মো. শহীদুজ্জামান বিল্পবের পিতাও কাউন্সিলর। মো. শহীদুজ্জামান বিল্পব পিতা আবুল কাশেম জীবননগর পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর। শহীদুজ্জামান বিল্পবের অনার্স চতুর্থ বর্ষের রোল নং ২০২৮১৭৭ ও নিবন্ধন নং ১৮২১৫০৩৯৪২৬। কিন্তু তার পরিবর্তে আগের টানা আটটি পরীক্ষাসহ সোমবারে অনুষ্ঠিতব্য পরীক্ষাটিও দিচ্ছিলেন ভুয়া পরীক্ষার্থী শামীম আহম্মেদ তুষার।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিষয়টি জেলা প্রশাসনের নজরে আসে। পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে পরীক্ষার হলে উপস্থিত হন জেলা কালেক্টরেটের সহকারী কমিশনার (শিক্ষা ও আইসিটি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুমাইয়া জাহান নাঈমা। সেখানে তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন, ১৯৮০-এর ৩ ধারা অনুযায়ী ভুয়া পরীক্ষার্থীকে এক বছরের জেল প্রদান করেন।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও সহকারী কমিশনার সুমাইয়া জাহান নাঈমা বলেন, ‘তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় ভুয়া পরীক্ষার্থীকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। আর যিনি প্রকৃত পরীক্ষার্থী তাঁকেও শনাক্ত করা হয়েছে। তাঁর ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ কলেজ কর্তৃপক্ষ নিবেন।’
তিনি আরও জানান, গোপন খবর পেয়ে আমরা তাকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি প্রথমে অস্বীকার করেন। তার কথাও প্রথম দিকে দৃঢ় কণ্ঠে ছিল। পরীক্ষার্থীর পিতার নাম্বার চাওয়া হলে, ভুয়া পরীক্ষার্থী আসল পরীক্ষার্থীর নাম্বার প্রদান করেন। তার সাথে কথা বলেই আরও বেশি সন্দেহ হয়। তিনি যে ওই পরীক্ষার্থীর পিতা নন, সেটি কথা শুনেই স্পষ্ট মনে হচ্ছিলো। তারপর ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করায় দুজনের কথার মিল পাওয়া যায় না। পরবর্তীতে ভুয়া পরীক্ষার্থী স্বীকার করেন। এছাড়াও তার কাছে একটি মুঠোফোনও পাওয়া যায়।
চুয়াডাঙ্গা সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সহযোগী অধ্যাপক মামুন অর রশিদ বলেন, অনার্স চতুর্থ বর্ষের পরিক্ষায় ২১৫ নম্বর কক্ষে ইতিহাস বিভাগের শহীদুজ্জামান নামের এক পরীক্ষার্থীর পক্ষে শামীম আহম্মেদ তুষার নামে একজন প্রক্সি দিচ্ছিলেন। বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরীক্ষা চলাকালে তাকে শনাক্ত করে। এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতে তাকে এক বছরের সাজা প্রদান করেন। ইতোমধ্যে আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষ মূল পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছি। এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রেরণ করেছি।
পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থী কীভাবে মুঠোফোন নিয়ে প্রবেশ করলো, এমন প্রশ্নের উত্তরে এই শিক্ষক বলেন, এসব কথা লেখার প্রয়োজন নেই।
তবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে আটটি পরীক্ষায় প্রক্সি দেওয়ার ব্যাপারটি ছড়িয়ে পড়লে সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের পরীক্ষা সংক্রান্ত নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে একজন চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীর টানা আটদিন প্রক্সি পরীক্ষা দেয়া এবং নবম দিনে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে শনাক্ত সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। সচেতন মহলের মানুষ বলছেন, একজন ভুয়া পরীক্ষার্থী নবম দিনে শনাক্ত হচ্ছে, তাও আবার তার কাছে মোবাইল ছিল। কেন্দ্রের মধ্যে মোবাইল নিয়ে প্রবেশের বিষয়েও প্রশ্ন উঠছে জনমনে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কলেজ কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব অবহেলার তীব্র নিন্দা চলছে। দাবি উঠেছে, কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার।
তবে চুয়াডাঙ্গা সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজেরও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, কলেজের সিনিয়র শিক্ষক এটি জানতেন। তাছাড়া ছাত্রলীগ নেতা সেটাও কলেজের কয়েকজন শিক্ষক জানতেন। তবে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সময় এটি কেউ বলেননি।
চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক (কমিটি নেই) সাধারণ সম্পাদক মো. জানিফ বলেন, শহীদুজ্জামান বিল্পব জীবননগর ডিগ্রি কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। প্রায় সাত বছর আগে কমিটি হয়েছে। ও পরবর্তীতে বোধহয় চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছে।
জীবননগর পৌরসভার ৬ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও মো. শহীদুজ্জামান বিপ্লবের পিতা আবুল কাশেম বলেন, আমি অত শিক্ষিত না। আমার ছেলে কি করেছে সেটা আমি জানতাম না। জানলে তো তাকে এই কাজ করতে দিতাম না।
জীবননগর পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. খোকন তুষারের পিতা নিশ্চিত করলেও এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এ ঘটনার আরও গভীর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।