ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আঞ্চলিক সড়ক: কাজ না করেই ঠিকাদারের পকেটে ৫৩ কোটি টাকা!
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রানা বিল্ডার্স লিমিটেড। ছবি: সংগৃহীত
দুই দফায় বেড়েছে প্রকল্পের সময়। প্রকল্পের পুরো টাকাও এখন ঠিকাদারের পকেটে। তবে শেষ হয়নি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ‘নবীনগর-শিবপুর-রাধিকা’ আঞ্চলিক মহাসড়কের এই প্রকল্পের কাজ। এ ছাড়া কাজের জামানত বাবদ যে অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা ছিল, তারও একটি অংশ তুলে নেওয়া হয়েছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগকে এখন এই কাজ বুঝে দিচ্ছে না ‘রানা বিল্ডার্স লিমিটেড’ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে সচেতন মহলে চলছে সমালোচনা।
অভিযোগ রয়েছে, সওজের তিন কর্মকর্তার যোগসাজশে এই অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। ‘রানা বিল্ডার্স লিমিটেড’ এর মালিক মোহাম্মদ আলম। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় ২০২২ সালে রংপুর অঞ্চলের সওজ ছয় মাসের জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে। শুধু তাই না, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকল্প সম্পন্ন না করেই ৪০ কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে নবীনগর-শিবপুর-রাধিকা আঞ্চলিক মহাসড়কের কাজ শুরু করে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রানা বিল্ডার্স। প্রকল্পটির কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে। তবে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ দুবার বাড়ানো হয়। কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৪ সালের ৩০ জুন।
নথি সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের ৭ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে উল্লেখ করে ২০২১ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের চূড়ান্ত বিল তুলে নেয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর মাত্র তিন মাস না পেরোতেই ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর জামানতের ৫০ শতাংশ অর্থও তুলে নেয় প্রতিষ্ঠানটি।
অনিয়মের পেছনে যারা:
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সওজ বিভাগ কুমিল্লা সার্কেলের অধীনে। রানা বিল্ডার্স যখন এই সড়কের নির্মাণকাজ করে, তখন কুমিল্লা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ছিলেন রানা প্রিয় বড়ুয়া। আর নির্বাহী প্রকৌশলী পংকজ দাস। কুমিল্লা অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন শওকত আলী।
সওজের কুমিল্লা সার্কেল সূত্র জানায়, পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ না করে বিল দেওয়ার কাজে জড়িত আছেন এই তিন কর্মকর্তা। এর মধ্যে পংকজ দাস বর্তমানে জামালপুরে কর্মরত। রানা প্রিয় বড়ুয়া নোয়াখালী সার্কেলে এবং শওকত আলী ময়মনসিংহ অঞ্চলে কর্মরত।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে শওকত আলীকে মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। পংকজ দাশের মোবাইল ফোনে কল দিলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে এ নিয়ে কথা হয় রানা প্রিয় বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘যখন কোনো কর্মকর্তা বদলি হন, তখন সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে নতুন জায়গায় দায়িত্ব নেন। বর্তমানে যারা কর্মরত আছেন, তাদের থেকে বক্তব্য নেন।’
সওজ ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ কাজ শেষ না হওয়া এবং বিল তুলে নেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ঘটনার সময় আমি ছিলাম না। তবে বিষয়টি ইতিমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
এদিকে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করলেও কুমিল্লা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জিয়াউল হায়দার জানান, ঘটনার সময় আমি ছিলাম না।
এখন ঠিকাদারকে অনুরোধ ২০২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর রানা বিল্ডার্সকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জিয়াউল হায়দার। এই চিঠিতে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন তিনি। তবে এই চিঠিতে সাড়া দেয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরপর আবারও চিঠি পাঠানো হয়। ৯ জানুয়ারি নির্বাহী প্রকৌশলী মীর নিজাম উদ্দিন আহমেদ রানা বিল্ডাসর্কে কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য চিঠি পাঠান। এরপরও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সর্বশেষ চিঠিতে বলা হয়, চূড়ান্ত বিল গ্রহণ এবং জামানতের ৫০ শতাংশ চেক গ্রহণ করেছেন। কিন্তু একাধিকবার অনুরোধ সত্ত্বেও কাজগুলো বুঝিয়ে না দেওয়ায় অত্র দপ্তর স্ব-উদ্যোগে কাজগুলো চিহ্নিত করাসহ মাঠপর্যায়ে প্রাথমিক মাপ গ্রহণ করে। তাতে দাখিলকৃত চূড়ান্ত বিলের সঙ্গে বাস্তবে সম্পাদিত কাজের পরিমাণে ব্যাপক ব্যত্যয় পাওয়া যায়। আগামী পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে সকল কাজ বুঝিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করা হলো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদার মোহাম্মদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, বিল তুলেছি ঠিক, কিন্তু পালিয়ে তো যাইনি। এখনো আমার জামানতের ১ কোটি ৩১ লাখ টাকা পাওনা আছে। যে সময়ে কাজ শুরু হয়, ওই সময়ে তারা (সওজ) জায়গা বুঝিয়ে দিতে পারেনি। যার কারণে পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ করা যায়নি। তবে দ্রুতই কাজ শেষ করে দেওয়া হবে।