পূর্ণ হলো ঐতিহাসিক ‘সলঙ্গা বিদ্রোহ’ দিবসের শত বছর
বৃহস্পতিবার (২৭ জানুয়ারি) ঐতিহাসিক রক্তাক্ত সলঙ্গা বিদ্রোহ দিবসের শত বছর পূর্ণ হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ পাঠাগার, সরকারি বেগম নূরুন নাহার তর্কবাগীশ ডিগ্রি কলেজ, সলঙ্গা সমাজ কল্যাণ সমিতি, তর্কবাগীশ মহিলা মাদ্রাসা, তর্কবাগীশ উচ্চ বিদ্যালয়, বিদ্রোহী সলঙ্গা ও সলঙ্গা ফোরাম সিরাজগঞ্জ পৃথকভাবে আলোচনা সভা, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, র্যালি ও পুরস্কার বিতরণসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে।
আমরা আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি বিদ্রোহের মহানায়ক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক জাতীয় নেতা মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশকে।
ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনে বিলেতি পণ্য বর্জন করে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের সংগ্রাম শুরু করেছিল আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ। এমনি একটি আন্দোলনের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে সলঙ্গায়।
সে সময় তৎকালীন পাবনা জেলার বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার সলঙ্গায় একটি ব্যবসায়িক জনপদ হিসেবে সপ্তাহে ২দিন হাট বসত। ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার ছিল বড় হাটবার। মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে অসযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের কর্মীরা হাটে নামে বিলেতি পণ্য কেনাবেচা বন্ধ করতে। আর এ আন্দোলনের কর্মীদের রুখতে ছুটে আসেন পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আরএন দাস, জেলা পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জ মহকুমা প্রশাসক এসকে সিনহাসহ ৪০ জন সশস্ত্র লাল পাগড়ীওয়ালা পুলিশ।
সলঙ্গার গো-হাটায় ছিল বিপ্লবী স্বদেশি কর্মীদের অফিস। পুলিশ কংগ্রেস অফিস ঘেরাও করে গ্রেপ্তার করে মাওলানা আব্দুর রশিদকে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে মুক্ত করতে প্রায় ৪০ হাজার জনতা সেদিন ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। জনতার ঢল দেখে ম্যাজিস্ট্রেট তাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ বাহিনীকে গুলি চালাতে নির্দেশ দেয়। শুরু হয়ে যায় বুলেট বৃষ্টি! এতে সলঙ্গার হাটে সাড়ে ৪ হাজার সাধারণ হাটুরে-জনতা শহীদ হন। হত্যাকাণ্ডে হতাহতের সরকারি সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজার দেখানো হলেও বেসরকারি মতে ১০ হাজারেরও অধিক।
মাওলানা আব্দুর রশিদ সলঙ্গা বিদ্রোহ উপনিবেশিক শাসনের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। সলঙ্গার রক্তসিক্ত বিদ্রোহ শুধু বাংলার মাটিকে সিক্ত করেনি, সিক্ত করেছে সমগ্র উপমহাদেশ। যে রক্তে ভেজা পিচ্ছিল পথে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তা সলঙ্গা বিদ্রোহেরই ফসল।
মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের অসাধারণ নেতৃত্বে গণমানুষের রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যায়ে সুসংগঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠায় তিনি পালন করেন বিশেষ ভূমিকা।
অসহযোগ, খেলাফত, ৪৭-এ পাকিস্তান অর্জন, ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান, ৭১-এর অসহযোগ ও মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেন।
অন্যদিকে, স্বাধীনতার রক্তসিঁড়ি ঐতিহাসিক সলঙ্গা বিদ্রোহেরও তিনি মহানায়ক। জাতীয় এ নেতা সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার তারুটিয়া (বর্তমানে তার নামানুসারে রশিদাবাদ) গ্রামে ১৯০০ সালের ২৭ নভেম্বর, বাংলা ১১ অগ্রহায়ণ ১৩০৭ সালে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সুপ্রসিদ্ধ আলেম ও পীর হযরত আবু ইসহাক (র.) ছিলেন উত্তর বাংলার একজন সুখ্যাতিসম্পন্ন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলালী (র.) এর বংশধর। স্বীয় মেধা, প্রজ্ঞা ও যুক্তি দিয়ে ইসলাম ও মুসলিম জাতি জাগরণে আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। অবশেষে ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট ইন্তেকাল করেন এই কর্মক্লান্ত সৈনিক।
এলএ/এমএসপি