চট্টগ্রামে ডায়রিয়ার প্রকোপ, খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ
সংগৃহীত ছবি
চট্টগ্রাম নগরীর আশপাশের উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়া। উপজেলা ও নগরীর হাসপাতালগুলোতে গড়ে প্রতিদিন ২০০ করে রোগী ভর্তি হচ্ছেন আবার অনেকে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। নগরীর পর সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়া রোগী বোয়ালখালী, আনোয়ারা, চন্দনাইশ ও পটিয়া উপজেলায়। এ ছাড়াও জেলার সব উপজেলায় ডায়রিয়া রোগী আছে। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে ভর্তি রোগীর মধ্যে বেশিরভাগই ডায়রিয়া রোগী। এরইমধ্যে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধানে চট্টগ্রামে এসেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ১২ সদস্যের একটি দল। তারা এখনো চট্টগ্রামে অবস্থান করছে।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ইলিয়াছ হোসেন বলেন,ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন উপজেলায় তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। চট্টগ্রামে খোলা হয়েছে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ। আইইডিসিআর একটি টিম পাঠিয়েছে কারণ উদঘাটনে। আমরা আশা করছি সহসা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
জানা গেছে, চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে ওয়াসা সরবরাহ করছে লবণাক্ত পানি। এজন্য ওয়াসার পানিকেই ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়ার পেছনে মূল কারণ হিসাবে মনে করছেন নগরবাসী। তবে ডায়রিয়া ছড়িয়ে পড়া নিয়ে চিকিৎসক ও চট্টগ্রাম ওয়াসার ভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। কারো মতে প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। আবার অনেকের মতে চট্টগ্রাম ওয়াসার লবণাক্ত পানির কারণে ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ছে। নগরীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে প্রচুর ডায়রিয়া রোগী।
এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম শহরের কাছের ৪ উপজেলার সরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছে অন্তত ৪ শতাধিক রোগী। তবে সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে এই সংখ্যা ২৯১ জন।
চিকিৎসকরা বলছেন, পানিবাহিত এই রোগ গ্রীষ্ম মৌসুমে কিছুটা বাড়ে। তবে এবার অনেক বেশি রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে। গরমে অতিষ্ঠ অনেকে বাইরে না গিয়ে ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। হঠাৎ করে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। অনেকে মনে করছেন, চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ রমজানের আগে থেকেই লবণাক্ত পানি সরবরাহ করছে। এসব পানি পান করে লোকজন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে নগরীর যেসব এলাকায় লবণাক্ত পানি সরবরাহ হচ্ছে সেখানে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীও বেশি। তবে চট্টগ্রাম ওয়াসার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বরাবরের মতো দাবি করেছেন, ওয়াসার পানিতে কিছুটা লবণাক্ততা আছে। তবে তা খুবই সহনীয় মাত্রায়। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার মতো লবণাক্ত নয়। তাছাড়া বৃষ্টিপাত শুরু হলে ওয়াসার পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ একেবারেই কমে যাবে। এরপর পানি নিয়ে উৎকণ্ঠার কিছু থাকবে না।
জানা গেছে, নগরীর বন্দর, হালিশহর, চকবাজার, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, খাজা রোড, মোহরা, ষোলশহর এলাকায় ডায়রিয়া রোগী বেশি। নগরীর এসব এলাকায় চট্টগ্রাম ওয়াসার সরবরাহ করা পানির লবণাক্ততা বেশি। এসব এলাকার সামর্থ্যবানরা ওয়াসার পানি বাদ দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জারের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানি কিনে পান করছেন। আর এই সুযোগে অসাধুরা প্রতি জার ৪০ টাকার স্থলে এখন ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা করে বিক্রি করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, জারের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানিও দূষিত। নগরবাসী যাচাই না করেই কিনে নিচ্ছেন। এতে ডায়রিয়া আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, বেসরকারি মা শিশু হাসপাতালে প্রচুর রোগী ভর্তি আছে। নগরীর আগ্রাবাদে মা ও শিশু হাসপাতালে শিশু ডায়রিয়া ইউনিট রোগীদের ভিড়ে কানায় কানায় পূর্ণ। আক্রান্তদের বেশির ভাগ শিশু ও বয়স্ক।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. একেএম রেজাউল করিম বলেন, গরমের মৌসুম শুরুর পর থেকে ডায়রিয়া রোগী বাড়ছে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। খোলা ও বাসী খাবার খাওয়া যাবে না। সচেতনতা বাড়লে ডায়রিয়া আক্রান্ত হওয়া থেকে রক্ষা মিলবে। এদিকে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব সতর্কতায় কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয়। সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরীর স্বাক্ষরে এসব নির্দেশনা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। একইসঙ্গে বেশ কয়েকটি উপজেলায় ডায়রিয়া প্রাদুর্ভাবের কারণ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জনস্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতে ডায়রিয়া প্রাদুর্ভাবের বিষয়টি অতি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার জন্য সকল উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে প্রদত্ত নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে সকল স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগে চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত খাবার স্যালাইন, ওষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রী মজুদ রাখতে হবে। ডায়রিয়া ও পানিবাহিত রোগের চিকিৎসায় জাতীয় গাইডলাইন অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
এদিকে ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে চট্টগ্রামে পৌঁছেছে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) ১২ সদস্যের একটি দল। রবিবার (৭ মে) রাতে দলটি চট্টগ্রামে পৌঁছায়। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের স্বাস্থ্য তত্ত্বাবধায়ক সুজন বড়ুয়া বলেন, আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবির সমন্বয়ে গঠিত একটি টিম চট্টগ্রামে এসেছে। তারা এখনো চট্টগ্রামে অবস্থান করছে। টিমের সদস্যরা ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ খুঁজতে আজ থেকে মাঠে কাজ শুরু করেছেন।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র জানায়, গত ৫ মে চট্টগ্রামে ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় আইইডিসিআরকে চিঠি দেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন। চিঠিতে চট্টগ্রামে ডায়রিয়ার কারণ অনুসন্ধানসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়। পরে গত ৬ মে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ১২ সদস্যের একটি দল গঠন করে চট্টগ্রামে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ অনুসন্ধানের জন্য নির্দেশ দেন। সেই টিমের সদস্যরা এখনো কাজ করে যাচ্ছেন।
এসআইএইচ