সাবেক চেয়ারম্যানের ভাটায় স্বপ্ন পুড়ছে কৃষকের
চোখ মেলে তাকালে চারদিকে কেবলই সবুজ আর সবুজ। এ যেন বিশাল এক সবুজের সমারোহ। বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে ফল ও ফসলে সবুজ প্রকৃতি আবৃত হয়ে থাকলেও এর মধ্যেই গড়ে উঠেছে পরিবেশ বিধ্বংসী ইটভাটা। ভাটার কুণ্ডলি পাকিয়ে উড়ছে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া!
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্ব দিঘলী এলাকায় ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে মেসার্স ভাই ভাই ব্রিকস। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সনাতন পদ্ধতিতে ভাটাটি পরিচালনা করছেন সাবেক চেয়ারম্যান শেখ মুজিব। তাইতো দীর্ঘসময় পার হলেও নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। অপরদিকে অনুমতিবিহীন এই ভাটার বিরুদ্ধে প্রশাসনের আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। ফলে বছরের পর বছর ধোঁয়ায় পুড়ছে কৃষকের স্বপ্ন আর রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
কেবল সদর উপজেলার ভাই ভাই ব্রিকসটি নয়, জেলার সবকটি ইটভাটা গড়ে উঠেছে ফসলি জমি, জনবসতিপূর্ণ আবাসিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকায়। মাঝেমধ্যে কয়েকটি ভাটায় জরিমানা ও গুঁড়িয়ে দিলেও বন্ধ হয়নি অবৈধ ইটভাটাগুলো। দেশের প্রচলিত আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চলছে ইটভাটার কার্যক্রম।
শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) সরেজমিনে মেসার্স ভাই ভাই ব্রিকসে গিয়ে দেখা যায়, পরিবেশবান্ধব চিমনির পরিবর্তে ‘ড্রাম চিমনি’ ব্যবহার করা হয়েছে। চারিদিকে স্তূপ করে রাখা হয়েছে কাঠ। এসব কাঠ ইট পোড়ানোর কাজে ব্যবহার করছেন। আর শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে শিশুরাও। ভাটায় ট্রাক্টর (পাওয়ার ট্রলি) দিয়ে ফসলি জমির উপরিস্তরের মাটি (টপ সয়েল) আনা হচ্ছে। ফলে গ্রামীণ কাঁচা-পাকা রাস্তাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এতে শিশু-বৃদ্ধ ও স্থানীয়দের চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ ছাড়া নিয়ম থাকলেও ১২০ ফুট উচ্চতার পাকা চিমনি দেখা যায়নি।
ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী, জনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কৃষি জমিতে কোনো ইটভাটা তৈরি করা যাবে না। ইটভাটায় থাকতে হবে ন্যূনতম ১২০ ফুট উচ্চতার পাকা চিমনি। এ ছাড়া জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করতে হবে কয়লা। কোনোভাবেই কাঠ কিংবা টায়ার পোড়ানো যাবে না।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে একাধিক কৃষক ও স্থানীয়রা জানান, ইটভাটার মালিকরা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় এলাকার কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পান না। আবার প্রকাশ্যেই পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করলেও তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনসহ পরিবেশ অধিদপ্তরও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
কৃষি বিভাগ বলছে, ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি (টপ সয়েল) চলে যায় ইটভাটায়। সেই মাটি পুড়িয়ে ভাটা মালিকরা তৈরি করছেন ইট। এতে কাঙ্ক্ষিত ফসলি জমির উৎপাদন কমে যাচ্ছে। কৃষকদেরও কৃষি কাজে অনীহা চলে এসেছে। এজন্য প্রতিবছরই কমছে ফসলি জমির পরিমাণ।
সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) আনোয়ার হোসেন বলেন, ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কারণে ফুসফুসের প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশিসহ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষতি হয় বেশি।
মেসার্স ভাই ভাই ব্রিকস এর স্বত্বাধিকারী শেখ মুজিব বলেন, অনুমোদনহীন ও সনাতন পদ্ধতিতে ইটভাটা পরিচালনা করা অপরাধ। ভবিষ্যতে এভাবে আর ভাটা পরিচালনা করব না। রাজনৈতিক বা সাবেক জনপ্রতিনিধির প্রভাব খাটিয়ে নয়, বিভিন্ন সংকট ও সমস্যার কারণে অনুমোদন ছাড়াই ইটভাটা পরিচালনা করছি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক হারুন অর রশিদ পাঠান বলেন, জনবল সংকট থাকার পরও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় অবৈধভাবে গড়ে উঠা ইটভাটায় প্রতিনিয়ত ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। আইন ভঙ্গকারী ইটভাটাগুলো বন্ধ ও জরিমানা করছি। সদর উপজেলার ভাই ভাই ব্রিকসেও খুব শিগগির অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ইমরান হোসেন বলেন, এটা আমার জানা ছিল না। কোনোভাবেই পরিবেশ ও কৃষি জমি ধ্বংসকারী ইটভাটা চলবে না। আমরা দিঘলীর এই ইটভাটাটির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।
এসজি