কীটনাশক ছিটিয়ে ৬০ বিঘা জমির ধান নষ্টের অভিযোগ

নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলায় ৬০ বিঘা জমির ধান খেতে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। এতে ওই খেতের ধান গাছ পুড়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। জমি নিয়ে বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষের লোকজন কীটনাশক ছিটিয়ে ধান গাছ নষ্ট করেছে বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের।
এ ঘটনায় গোপাল চন্দ্র রায় নামের এক কৃষক গত বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) পত্নীতলা থানায় উপজেলার মানসি গ্রামের বাসিন্দা আলতাফ হোসেন, বাদল, কাজল মোল্লা, মতিউর রহমান, সিকদার আলীসহ ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় লিখিত অভিযোগ করেন।
লিখিত অভিযাগ সূত্রে জানা যায়, উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের মানসি মাঠে কিসমত গাবিন্দপুর মৌজায় গোপাল চন্দ্র রায়ের ১৩ একর (৩৯ বিঘা) জমি রয়েছে। ওই মাঠে গোপাল চন্দ্র তার ব্যক্তি মালিকানাধীন ৩৯ বিঘা জমির মধ্য ১২ বিঘা জমিতে নিজে ধান চাষ করেছেন এবং অন্যান্য জমিগুলো তিনি বর্গা দিয়েছেন। বর্গাদার কৃষকরা জমিগুলোতে আমন ধান চাষ করেছেন। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে গত ১৭ অক্টোবর বিকালে মানসি গ্রামের আলতাফ, বাদল, কাজল মোল্লা, সিকদার আলীর নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জন দুবৃর্ত্ত দেশীয় অস্ত্রসহ নিয়ে অনধিকার প্রবেশ করে স্প্রে মেশিন দিয়ে তার জমিতে বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করে। স্থানীয় কৃষকরা এ বিষয়ে মুঠোফোনে গোপাল রায়কে জানালে তিনি তাৎক্ষণিক খেতে ছুটে যান। তাকে দেখতে পেয়ে প্রতিপক্ষের লোকজন তাকে মারতে উদ্যত হলে তিনি প্রাণভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। এ ঘটনার পর দিন থেকে খেতের ধান বিবর্ণ হতে শুরু করে। যতই দিন যাচ্ছে খেতের ধান গাছগুলা বিবর্ণ হয়ে শুকনা খড়ের মতো হয়ে যাচ্ছে। এতে তার প্রায় ১২ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের দাবি, গোপাল চদ্র রায়ের জমির ধান গাছের যারা ক্ষতি করেছেন ওই ব্যক্তিরাই তাদের জমির ধান গাছে কীটনাশক ছিটিয়ে নষ্ট করেছেন।
অভিযোগকারী গোপাল রায় বলেন, ‘মানসি মাঠে সাড়ে ৬ একর (১৯ বিঘা) দেবোত্তর সম্পত্তি রয়েছে। উপজেলার কাটাবাড়ি রাধা গোবিন্দ জিউ মন্দিরের দেবতার নামে আমার পূর্ব পুরুষরা ওই সব জমি দান করে গেছেন। দীর্ঘদিন ধরে দেবোত্তর সম্পত্তিগুলা মন্দির কমিটির তত্ত্বাবধানে স্থানীয় গরিব ও অসহায় কৃষকরা বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে আসছেন। চলতি বছর দেবোত্তর সম্পত্তিতে খাদইল, সুকর্ণপুর, কিসমত গাবিন্দপুর গ্রামের আদিবাসী বর্গাদার কৃষকরা আমন ধানের চারা রোপন করতে গেল মানসি গ্রামর আলতাফ, বাদল, কাজল মোল্লা, সিকদার আলী ও তাদের লোকজন বাধা দেন। এ ঘটনায় পত্নীতলা থানায় একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। ওই ঘটনার পর থেকে আলতাফ, কাজল ও বাদল এবং তাদের লোকজন তাকে নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিল। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে তারা আমার ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৩ একর জমির ধান গাছ ও দেবোত্তর সম্পত্তির জমিতে লাগানো ধান গাছ নষ্ট করেছে। প্রায় ৬০ বিঘা জমির ধান কীটনাশক দিয়ে পুড়ে ফেলা হয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাছি।’
শনিবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে মানসি মাঠে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের প্রায় মাঝ বরাবর অংশ বেশ কয়েকটি খেতের ধান বিবর্ণ হয়ে শুকনা খড়ের মতো হয়ে গেছে। খেতগুলোর আইলের ঘাসও বিবর্ণ হয়ে গেছে। অথচ ওই সব খেতের পাশ ও মাঠের অন্যান্য খেতের ধান গাছ ভালো রয়েছে। ঝলসে যাওয়া ধান খেত দেখতে অর্ধশতাধিক কৃষক মাঠ জড়ো হয়েছেন।
এ সময় কথা হয় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক মানসি গ্রামের বাসিন্দা খাদেম আলীর সঙ্গে। খাদেম আলী বলেন, গোপাল রায়ের কাছ থেকে ৬ একর জমি বর্গা নিয়ে কয়েক বছর ধরে তিনি ধান আবাদ করেছেন। এবারও তিনি বর্গা নিয়ে ওই সব জমিতে গত শ্রাবণ মাসে আমন ধানের চারা লাগান। ধান গাছগুলো থেকে শীষ বের হতে শুরু করছিল। কিন্তু শত্রুতার জেরে তার খেতে কীটনাশক প্রয়োগের কারণে এখন মাঠের সব ধান গাছ বিবর্ণ হয়ে গেছে। দিন যতই গড়ায় খেতের ধান ততই বিবর্ণ হয় যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ‘৬ একর জমিতে প্রায় ৫০০ মণ ধান পেতাম। জমির মালিককে ভাগ দেওয়ার পর ২৫০ মণ থাকত। সেই ধান দিয়ে আমার সংসার খরচ চলত। এখন এক মণ ধানও পাব না। এখন কীভাবে আমার দিনপথ চলবে? ভেবেই পাচ্ছি না।’
বর্গাচাষী সুকর্ণপুর গ্রামের বিশ্বনাথ ও খাদইল গ্রামের সুবাস বলেন, রাধা গাবিন্দ জিউ দেবতার নামে দান করা সম্পত্তিতে তারাসহ সুকর্ণপুর ও খাদইল গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কৃষকরা আমন ধান আবাদ করেছিলেন। জমির দখল নেওয়ার জন্য মানসি গ্রামের আলতাফ, সিকদার, কাজল মোল্লারা তাদের খেতে কীটনাশক দিয়ে ধান গাছ নষ্ট করে দিয়েছে। কিছু দিন আগেও তাদের খেতের ধান সবুজ ছিল। কিন্তু ১৭ অক্টোবর জোর করে জমিতে ক্ষতিকারক কীটনাশক ছিটিয়ে দেওয়ার পর থেকে ধান গাছ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে কীটনাশক ছিটিয়ে ধান গাছ নষ্ট করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মানসি গ্রামের সিকদার আলী। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। যারা অভিযোগ করেছেন তারাই জমিতে কীটনাশক দিয়ে ধান গাছ নষ্ট করেছেন।’
সিকদার আলী আরও বলেন, ‘জমিগুলা নিয়ে নজিপুরের গোপাল রায়ের সঙ্গে উপজেলার শিবপুর গ্রামের বজলুর রহমান ও মানসি গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমানের বিরোধ চলে আসছে। এক সময় জমিগুলো গোপাল রায় ভোগ দখল করত। তবে গত প্রায় ৩০ বছর ধরে জমিগুলো ভোগ দখল করছে বজলুর রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমান। বজলু ও মোস্তাফিজুরের কাছ থেকে জমি বর্গা নিয়ে আমিসহ মানসি গ্রামর ১০-১২ জন কৃষক চাষাবাদ করে আসছি। এবারও তারা আমন ধান লাগিয়েছিলেন। কিন্তু এক সপ্তাহ আগে প্রতিপক্ষের লোকজন জমিতে কীটনাশক ছিটিয়ে ধানগাছ মেরে ফেলেছে। কীটনাশক ছিটানোর ভিডিও আমাদের কাছে রয়েছে। তদন্ত হলেই প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসবে।’
এ ব্যাপারে পত্নীতলা থানার পরিদর্শক অর্পণ কুমার দাস বলেন, শত্রুতার জেরে কীটনাশক দিয়ে ধান ঝলসে দেওয়ার বিষয় গোপাল চন্দ্র রায় নামে এক কৃষক থানায় অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি তদন্ত চলছে। তদন্ত যারা দোষী প্রমাণিত হবেন তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
এসআইএইচ
