কালের সাক্ষী সিলেটের ঐতিহাসিক ক্বিন ব্রিজ
‘সহসা ফিরিয়ে চোখ দিয়ে দেখি দূর পুবাকাশে/তরুণ রক্তের মতো জাগে লাল সাহসী অরুণ /পাখির কাকলি জাগে। ঝিরঝিরে শীতল বাতাসে/দিনের যাত্রার শুরু। অন্তরালে রজনী করুণ!/ধারালো বর্শার মতো স্বর্ণময় সূর্যরশ্মি ফলা/ক্বিন-ব্রিজে আঘাত হানে। শুরু হয় জন তার চলা।
’জানাচ্ছি সিলেটের ঐতিহাসিক ক্বিন ব্রিজের কথা। নিচে সুরমার স্বচ্ছ জল। নদীর দু’তীরে নাইতে নেমেছে কিশোরের দল। ঢেউয়ের তালে নৌকাগুলো ছুটছে এপার-ওপার। ব্রিজের ঠিক নিচে (উত্তরপাড়ে) রয়েছে ত্রিমুখী চত্বর। এখান থেকে পশ্চিম দিকে এই রাস্তা সিলেট কোতয়ালি থানা হয়ে চলে গেছে কাজিরবাজারে। আর পূর্ব দিকে সার্কিট হাউসের রাস্তা ঘেঁষে চলে গেছে কালিঘাট ও মহাজনপট্টিতে। আর উত্তর দিকের সোজারাস্তাটি সুরমা মার্কেট হয়ে বন্দরবাজার।
ব্রিজটির ঠিক উত্তর-পূর্ব কোণে সিলেট সার্কিট হাউস, দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে ঐতিহাসিক আলী আমজদের ঘড়ি। ব্রিজের নীচে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ‘রবীন্দ্র্র স্মৃতিস্তম্ভ’। ঠিক বিপরীত পাশে সিলেটের আরও এক ঐতিহ্যের স্বাক্ষর ‘সারদা স্মৃতি’ হল। আর এক কদম এগোলেই সিলেটের কিংবদন্তিপ্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব পীর হবিব নামকরণে‘পীর হবিব পাঠাগার’।
ক্বিন ব্রিজ ছাড়াও সিলেটে সুরমা নদীর উপর ব্রিজ রয়েছেআরো দুটি। পাশাপাশি অবস্থিত আরো দুটি ব্রিজ যথাক্রমে শাহজালাল ব্রিজ এবং কাজিরবাজার ব্রিজ। কিন্তু সিলেটে কালের সাক্ষি এবং ঐতিহ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এই ক্বিন ব্রিজ। ক্বিন ব্রিজ সংলগ্ন এই স্থানে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থাপনা রয়েছে।
১৯৩৬ সাল থেকে এই ক্বিন ব্রিজ দিয়ে চলছে জনতার পথচলা। এই ক্বিন ব্রিজ সিলেটকে রেখেছে অনন্য উচ্চতায়। এই ক্বিন ব্রিজ পরিদর্শনে এসে মুগ্ধ হয়েছেন দেশি-বিদেশি পর্যটকেরা। ব্রিজটি নিয়ে গণ মানুষের কবি দিলওয়ার লিখেছেন বিখ্যাত কবিতা ‘ক্বিন ব্রিজে সূর্যোদয়’। কবি দিলওয়ার নেই। আছে সিলেটের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত ঐতিহাসিক ক্বিন ব্রিজ। ৮৬ বছরের এই ব্রিজটির উপর দিয়ে ধকল গেছে যৌবনে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ কালে পাকিস্থানী হায়েনারা ডায়নামাইট দিয়ে ব্রিজটির উত্তরপাশের একাংশ উড়িয়ে দেয়।
পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সহযোগিতায় ব্রিজের বিধ্বস্থ অংশটি কংক্রিট দিয়ে পুন নির্মাণ করা হয়। সংস্কারকৃত ব্রিজটির উদ্বোধন করেন তৎকালীন নৌ বাহিনীর প্রধান রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান। সুরমা নদীর উপর লৌহনির্মিত সেতুটি সিলেটের অন্যতম একটি দর্শনীয় এবং ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সবার কাছে পরিচিত।
এই ব্রিজটিকে সিলেট শহরের ‘প্রবেশদ্বার’ বলা হয়। শহরের কেন্দ্র্রস্থলে অবস্থিত ব্রিজটির এক দিকে দক্ষিণ সুরমা ও অপরদিকে তালতলা। সিলেট রেলওয়ে স্টেশন থেকে এই ব্রিজটি মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ব্রিজটির নামকরণ করা হয় আসামের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল ক্বিনের নামানুসারে। গভর্নর থাকাকালীন (১৯৩২-১৯৩৭) তিনি সিলেট সফরে আসেন। তাঁর স্মৃতিকে অম্লান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার তাগিদ থেকেই সুরমা নদীর উপর এ ব্রিজটি নির্মাণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করাহয়।
এরই অংশ হিসেবে রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমানদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং নির্মাণ শেষে ১৯৩৬ সালে ব্রিজটি আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেওয়া হয়। ১১৫০ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ১৮ ফুট প্রস্থের ব্রিজটি নির্মাণে তৎকালীন সময়ে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। ২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সংস্কারের জন্য ক্বিন ব্রিজ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)।
এর আগে প্রবেশমুখে লাগানো হয় সাইনবোর্ড। সেখানে উল্লেখ করা হয়রিকশা, ভ্যান ও মোটরসাইকেল ব্যতিত অন্য সব ধরনের যানবাহন এ সেতু দিয়ে চলাচল করতে পারবে না। কিন্তু এসবের কোনো পাত্তাই দেয়নি গাড়ি চালকরা। কর্তৃপক্ষও নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে নেয়নি কোনো উদ্যোগ। নিষেধাজ্ঞা প্রদান ও ভঙ্গের এক আজব খেলা চলছিল ক্বিন ব্রিজ ঘিরে।
ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজটিতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েক বার সংস্কার কাজ করা হয়েছে। ফলে ওই সময় বন্ধকরে দেওয়া হয় রিকশা চলাচলও। তবে দক্ষিণ সুরমার মানুষের দাবির প্রেক্ষিতে কিছুদিন পর রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেল চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কে বা কারা লোহার ব্যারিকেড তুলে ফেলে। শুরু হয় সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, লাইটেসসহ সব ধরনের যান চলাচল।
এদিকে সিলেটের অধিকাংশ মানুষের দাবি, ব্রিজটি যান চলাচল মুক্ত রাখা হোক এবং সেটি হলে সিলেটের ক্বিন ব্রিজ হবে বিশ্বের একমাত্র পায়ে হাঁটার ব্রিজ। সিলেট সিটি করপোরেশন একবার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও দক্ষিণ সুরমার অধিকাংশ মানুষ সেটির বিরোধীতা করে সিসিকের বিরুদ্ধে আন্দোলনমুখী হয়ে উঠে। ব্রিজের উপর দিয়ে দক্ষিণ সুরমায় যাচ্ছিলেন গীতিকার ও সিলেট বেতারের শিল্পী সিরাজ আনোয়ার।
তিনি বলেন, ইতিহাসের অংশ এই সিলেট ক্বিন ব্রিজ। ব্রিজের বিভিন্ন স্থানে এখন গর্ত। সোডিয়াম বাতিগুলো অকার্যকর। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে আশু হস্তক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানান।