কীটনাশক প্রয়োগে পুড়ল ৫ লাখ টাকার পেঁয়াজ বীজ
নওগাঁর মহাদেবপুরে কীটনাশক প্রয়োগের মাত্র তিন দিনের মধ্যেই পুড়ে গেছে প্রায় পাঁচ লাখ টাকার পেঁয়াজ বীজ। স্বপ্ন ভেঙে এখন মাথায় হাত এ পেঁয়াজ বীজ চাষির। কীটনাশকের ডিলার বলছেন, ভালো কোম্পানির ভালো ওষুধ দিয়েছেন। আর কৃষি বিভাগ বলছে ওই কীটনাশক পেঁয়াজের জন্য নয়।
ভূমিহীন দিনমজুর চাষি দুলাল হোসেন। নিজের জমি নেই। তাই ইউপি চেয়ারম্যান সামসুল আলম বাচ্চুর ১৭ কাঠা জমিতে লাগিয়েছেন পেঁয়াজ বীজ। গত বছর ৫ জাতের পেঁয়াজ লাগিয়ে সফলতা পেয়েছিলেন। তাই এবার স্ত্রীর মাধ্যমে দুটি এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এ জমিতে ১০ মণ পেঁয়াজ লাগিয়েছেন। খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকার পুরোটাই। তার উপর নিজেদের শ্রম তো রয়েছেই।
গত কার্তিক মাসে লাগিয়ে পাঁচ মাস ধরে তিল তিল করে শ্রম ঘামে সময় দিয়েছেন এ জমিতে। সোনালী স্বপ্ন বুনেছেন ঘাম ঝরানো চিক চিক করা চোখে। আর মাত্র দুসপ্তাহ পরেই ঘরে উঠত পেঁয়াজের বীজ। বাজারে পেঁয়াজের বীজের দাম অনেক। গত বছর বিক্রি হয়েছে তিন হাজার ২০০ টাকা কেজি দরে। এবার বিক্রি হচ্ছে এক হাজার ৮০০ টাকায়। ১৭ কাঠা জমি থেকে কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকার পেঁয়াজ বীজ উঠত।
সোমবার (২৮ মার্চ) দুপুরে ওই এলাকায় গিয়ে গ্রামীণ সড়কের পাশেই এ পুড়ে যাওয়া পেঁয়াজ বীজের ক্ষেত দেখে খোঁজ নিতে গেলে কৃষক দুলাল দোকানের কয়েকটি রশিদ দেখিয়ে জানালেন, প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের সার আর কীটনাশক কিনতেন সফাপুর ইউনিয়ন সদরের পাহাড়পুর বাজারের কীটনাশকের ডিলার নাহিদের দোকান থেকে। তারই পরামর্শে এ খেতে যাতে কোনো পোকা না লাগে, আর পঁচামিনা রোগে যেন আক্রান্ত না হয়, সেজন্য গত ১৬ মার্চ তার দোকান থেকে পেঁয়াজের বীজের ক্ষেতে প্রয়োগের জন্য কিনে আনেন বায়ার কোম্পানির নাটিভো-১০ গ্রাম ১২০ টাকায় ও সলোমন-১০০ মিলিগ্রাম ২৪০ টাকায়।
তিনি জানান, কয়েক দিন আগে সেগুলো ডিলারের পরামর্শ মতো পানির সঙ্গে মিশিয়ে প্রয়োগ করেছেন পেঁয়াজের বীজের জমিতে। কিন্তু তিন দিন পরেই সব শেষ। সাদা সাদা বীজগুলো পুড়ে কালো বর্ণ ধারণ করেছে। দুএকটি গাছে সাদা সাদা বীজ এখনও থাকলেও পুড়ে ছাঁই হয়েছে কৃষক দুলাল-আসমা দম্পতির সব স্বপ্ন।
কৃষক দুলালের স্ত্রী আসমা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেন, ক্ষেতের ফসল হারিয়ে তার স্বামী একেবারে ভেঙে পড়েছেন। দুই সমিতির কিস্তির টাকা কোত্থেকে দেবেন তা নিয়েও দিশেহারা। নিরুপায় হয়ে প্রায়ই দুলাল আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছেন।
জমির পাশেই চোখে পড়ল গ্রামের একটি ঢোকের দোকান। দোকানি মহির উদ্দিনের ছেলে দবির উদ্দিন জানালেন, এ বিষ ছাড়া পেঁয়াজের বীজ পুড়ে যাবার আর কোনোই কারণ নেই। অন্য গ্রামবাসীরও একই মত। তারা দরিদ্র কৃষক দুলালের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
পাহাড়পুর বাজারে গিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের গেটের সামনেই দেখা গেল ওই ডিলার রায়হান কবির নাহিদের কীটনাশকের দোকান ‘মাস্টার কৃষি ক্লিনিক’। তার পিতা আব্দুল জলিল মাস্টারের নামে এ দোকান। কিন্তু সেটি বন্ধ। সাইন বোর্ডে লেখা মোবাইলফোনে রিং দিলে নাহিদ কৃষক দুলালকে ওই কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ‘কেন পুড়ে গেল সেটার জন্য কোম্পানিকে বলেন।’
পরামর্শ দেওয়ার জন্য তিনি কোনো ট্রেনিং নিয়েছেন কি না সে ব্যাপারে তিনি কিছু জানাতে পারেননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ অরুন চন্দ্র রায় জানান, নাহিদ একজন লাইসেন্সধারী কীটনাশক বিক্রেতা। কিন্তু ওই দুটি কীটনাশক পেঁয়াজ বীজের জন্য প্রযোজ্য নয়। সেগুলো শুধু ধানের ক্ষেতে প্রয়োগ করা হয়। এ ছাড়া পেঁয়াজ বীজ এখন ওঠার সময়। এসময় কোনো কীটনাশকের প্রয়োজনই পড়ে না। ওই বিক্রেতা বিক্রি বাড়াতে না জেনেই ওই কীটনাশক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
কৃষি কর্মকর্তা আরও জানান, একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে ওই এলাকায় পাঠাচ্ছেন। ভুল পরামর্শ দিয়ে কৃষকের ক্ষতি হওয়ায় ওই কীটনাশক বিক্রেতার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থার কথা জানান তিনি।
এসএন