মানব জীবনে সময়ই মূলধন
জীবন সময়ের সমষ্টি। সময়ই জীবন। অমূল্য মানব জীবনে সময়ই মূলধন বা পুঁজি। মানব জীবন এক অনন্ত সফর। জন্ম ও মৃত্যু এরই একটি পর্বের সূচনা ও সমাপন। সময়ের আবর্তনে প্রতি নিয়ত বয়স বাড়ে ও আয়ু কমে। সময় আল্লাহর দান। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারীমে ইরশাদ করেন: “মহামহিমান্বিত তিনি, সর্বময় কর্তৃত্ব যাঁর করায়ত্ব, তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান। যিনি সৃজন করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদিগকে পরীক্ষা করার জন্য- কে তোমাদের মধ্যে কর্মে উত্তম? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল। (সূরা-৬৭ মুলক, আয়াত: ১-২)। “মহাকালের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত, কিন্তু তারা নয় যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যেও উপদেশ দেয় ও ধৈর্যেও উপদেশ দেয়।” (সূরা-১০৩ আছর, আয়াত: ১-৩)।
মহাকালের পরিক্রমায় একটি অংশ সৌর ও চান্দ্র বর্ষ, যা বারোটি মাসে বিভাজিত। কুরআনের ভাষায়- ‘নিশ্চয়ই আকাশমন্ডলী পৃথিবী সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারোটি।” (সূরা-৯ তাওবা, আয়াত: ৩৬)। কোরআন মাজীদে আরও রয়েছে: “তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং উহাদের মনজিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বৎসর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এ সমস্ত নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।” (সুরা-১০ ইউনুস, আয়াত: ৫)। আল্লাহ আরও বলেন: “আর সূর্য ভ্রমণ করে উহার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে, ইহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের নিয়ন্ত্রণ। এবং চন্দ্রের জন্য অমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন মনজিল; অবশেষে উহা শুষ্ক বক্র পুরাতন খর্জুর শাখার আকার ধারণ করে।” (সূরা-৩৬ ইয়াসীন, আয়াত: ৩৮-৩৯)।
কালচক্রে বছর যায়, বছর আসে। বছর যাওয়া মানে তওবার মাধ্যমে পুরাতন ত্রুটিগুলো মুছে ফেলার সুযোগ। নতুন বছর আসা মানে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হওয়া। বিগত সময়ের ব্যর্থতা গ্লানি ভুলে নব উদ্যমে নতুনের কেতন উড়ানোর আনন্দ উপভোগ করা। অকল্যাণের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে অবারিত কল্যাণের পথে ধাবিত হওয়ার শুভ যাত্রা শুরু করা। তাই নতুন বছর এলে পড়া হয়- ‘ইয়া মুকাল্লিবাল-কুলূবি ওয়াল-আবছার, ইয়া মুদাব্বিরাল-লাইলি ওয়ান-নাহার; ইয়া মুহাওয়িলাল-হাওলি ওয়াল-আহওয়াল, হাওয়িল হালানা ইলা আহ্ছানিল হাল।’ অর্থাৎ ‘হে অন্তরসমূহ ও দৃষ্টিসমূহ পরিবর্তনকারী! হে রাত ও দিনের আবর্তনকারী! হে সময় ও অবস্থা বিবর্তনকারী! আমাদের অবস্থা ভালোর দিকে উন্নীত করুন।’ (দিওয়ানে আলী রা., আন নাহজুল বালাগা)। নতুন মাস দিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। নতুন মাসে মহান প্রভুর কাছে এই আবেদন: “আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমান, ওয়াছ-ছালামাতি ওয়াল-ইসলাম; রব্বী ওয়া রব্বুকাল্লাহ; হিলালু রুশদিন ওয়া খায়র।” অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি এই মাসকে আমাদের জন্য নিরাপত্তা, ঈমান, প্রশান্তি ও ইসলাম সহযোগে আনয়ন করুন; আমার ও তোমার প্রভূ আল্লাহ। এই মাস সুপথ ও কল্যাণের।’ (তিরমিযী: ৩৪৫১)।
আল্লাহ সময়ের স্রষ্টা, তিনিই সময়ের মালিক ও নিয়ন্ত্রক। সময়ের সঙ্গে কোনো অমঙ্গল বা অকল্যাণের সংযোগ নেই। কল্যাণ অকল্যাণ ও মঙ্গল অমঙ্গল মানুষের কর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত। হাদীস শরীফে আছে, আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তোমরা সময়কে দোষারোপ করো না, কালকে গাল মন্দ করো না; কারণ আমিই মহাকাল, আমিই সময়ের নিয়ন্তা। (হাদীসে কুদসী)।
যেহেতু নববর্ষ হলো সময়ের একটি অংশ থেকে অন্য অংশে পদার্পন, তাই এটি হলো নিজেকে পরিবর্তন ও উন্নয়নের একটি সুযোগ। সুতরাং এই সময় আমাদের যা করা উচিৎ তা হলো জীবনকে নবায়ন করা। জীবনের জন্য আল্লাহ’র শোকরিয়া করা। নেক হায়াত ও সুস্বাস্থ্যের জন্য দোয়া করা। অতীতের গুনাহ হতে তাওবা করে, কৃতভুলের জন্য ইস্তিগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনা করা। কারো জান, মাল ও ইজ্জতের ক্ষতি করে থাকলে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ও সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ করা। ভবিষ্যতে নেক আমলের সংকল্প করা। বিগত সময়ে কেউ বিরূপ আচরণ করে থাকলে মন থেকে তা ক্ষমা করে দেওয়া। কারও কাছে বৈধ দেনা পাওনা বা লেনদেন থাকলে, তা আদায়ে বিধিসম্মত সামাজিক পন্থা অবলম্বন করা।
মানুষের সকল কর্মই আমল নামায় সংরক্ষিত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তার জন্য করিৎকর্মা প্রহরী রয়েছে তার নিকটেই।’ (সূরা-৫০ কাফ, আয়াত: ১৮)। পরকালে রোজ হাশরে বিচারের দিনে মানুষ তার নিজের আমলনামা দেখে বলবে: ‘উপস্থিত করা হবে আমলনামা, তাতে যা লিপিবদ্ধ আছে তার কারণে তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে আতঙ্কগ্রস্ত, তারা বলবে- হায়! দুর্ভাগ্য আমাদের! এটি কেমন গ্রন্থ! তা তো ছোটো বড়ো কিছুই বাদ দেয়নি বরং তা সমস্ত হিসাবই রেখেছে। তারা তাদের কৃতকর্ম সম্মুখে উপস্থিত পাবে, তোমার প্রতিপালক কারও প্রতি জুলুম করেন না।’ (সূরা-১৮ কাহাফ, আয়াত: ৪৯)।
পরিণতি চিন্তা করেই কর্ম করা বাঞ্ছনীয়। সম্পাদনের পূর্বে যে আমলটি নির্দোষ বা মুবাহ তাও কার্যকরী করার পর নেকী বা বদীতে পরিণত হয়। মানব কল্যাণ ও সৎকর্মের মাধ্যমে জীবনের অমূল্য সময়কে মূল্যায়িত করাই বুদ্ধিমানের পরিচয়।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক: শেখ ছাদী (র.) ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ