স্যার ম্যাডাম বিতর্ক: সামন্তযুগে বাংলাদেশ
কে মালিক? কে প্রভু? কে সরকারি? কে বেসরকারি? কে স্যার? কে ম্যাডাম? এই বিতর্ক আবার আমাদের সামনে নতুন করে নতুনভাবে পুরোনো মোড়কে সামনে এসেছে। সরকারি কর্মকর্তারা সার বা ম্যাডাম নয় শুধু শিক্ষকরা স্যার ম্যাডাম এ কথাটি আমাদের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন ৭ই সেপ্টেম্বর ২০২১ সালে প্রায় দু বছর আগেই। সরকারি কোন ঘোষণা প্রজ্ঞাপণ ছাড়া আদতে এর কোন সমাধান আছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও এই স্যার সাহেব, বাবু, মহাশয় ডাকাডাকি নিয়ে এই চিৎকার কতটা প্রাসঙ্গিক সেটা অনুসন্ধানের দাবি রাখে।
উপনিবেশিক আমলের রাজ-কর্মচারীকে সমীহ করে স্যার ডাকার সংস্কৃতি ছিল। কারণ তারা ছিল অত্যাচারী, নির্যাতক, এই ডাক তাদের জন্য রহমত নিয়ে আসতো। শুধু এই ভয়ে আমজনতা তাদের স্যার ডাকতো বলে শোনা যায় কিন্তু‘ স্যার শব্দের সাথে যে ভালোবাসানিসৃত হয়ে এই শব্দকে শক্তিশালী করে তোলে সেটা নিতান্তই শ্রদ্ধার। আর এই শ্রদ্ধা আপনি জোর করে পাবেন না, এটা ভিতরের ব্যাপার। ঔপনিবেশিক আমলের দুই পর্ব শেষ করে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীন প্রজাতন্ত্রের জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণার মধ্যে যে সার্বজনীন ঘোষণা আছে সেখানে স্যার ঢাকার কোন যৌক্তিক কারণ নেই। কেননা দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের (৭) ১ অনুচ্ছেদে বলা আছে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। অন্যদিকে সংবিধানের (২১) ২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার সাথে জড়িত কর্মচারীরা হলেন প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। বাংলায় বুঝতে সমস্যা হলে ইংরেজি ভার্শনে এই কথাটি স্পষ্ট করে বলা আছে। ইংরেজিতেই আছে সবচাইতে ভালো সমাধান পাবলিক সার্ভেন্ট আর আর এটাই বাংলার সরল অনুবাদ। ১৯৭২ সালেও সরকারি কর্মচারিদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণ আজ আমরা ভুলতে বসেছি। সত্য বলতে দেশ এখনো টিকে আছে মেহনতী মানুষের অবদানের উপর ভর করে। তাদের শ্রমে ঘামে যাদের বেতন, বোনাস, তাদের প্রতি এই অবজ্ঞা, অপমান দেশের প্রশাসন যন্ত্রনিয়ে এক চরম অনিশ্চয়তা ইঙ্গিত দেয়। রাজ-কর্মচারীরা নিজেদের সবচেয়ে মেধাবী ভেবে থাকেন, অবশ্য ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার থেকে নয় তাহলে তারা এটা কেন বোঝেন না সেবা প্রদানের যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে তিনি চেয়ারে বসে আছেন প্রকৃত অর্থে সেই চেয়ারের মালিক তিনি নন এটা তিনি না বুঝলেও অন্তত আমরা এটা বুঝি। সক্রেটিসের সেই কথাটিই আজ বড়বেশি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় “মুর্খের সবচাইতে বড় সমস্যা হলো সে যে আসলে মূর্খ এটা না জানা” আবার সে যে কিছুই জানেনা সে কথাটাই আসলে সে জানে না। আর আমরা কণ্ঠশিল্পী হায়দার হোসেনের সেই গানের কথাতো জানিই“ আমি সরকারি অফিসার আমি এ যুগের জমিদার”। পুর্বের জমিদার আর সামন্ত প্রভূদের জায়গা নিতে চাই আজকের আধুনিক আমলাতন্ত্র। সবচেয়ে বড় কথা বিগত দশকগুলো বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেভাবে আমলাতন্ত্রে বিকাশ হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতাকে আশ্রয় করে সেখানে পাল্টে গেছে মৌলিক ধারণা। এক সময় রাজনীতি ও প্রশাসন প্রতিপক্ষ থাকলেও হাল আমলে তারা এক অন্যের সহযোগী। জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের তকমার অভ্যন্তরে প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারী জনগণের সেবক এবং তারা কখনোই সেবক হয়ে মনিবের জায়গা নিতে পারেনা, ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র মূল ভিত্তিই ছিল এটাই। বেশ কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর কামরুল হাসান মামুন বলেছিলেন “রাষ্ট্রের মানসিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে সর্বপ্রথম শিক্ষা ব্যবস্থা ঠিক করতে হবে যতদিন এটা ঠিক না হবে ততদিন শিক্ষা ও চেতনা মেরামত সম্ভব নয়। যারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আছেন তারা নিজেকে শিক্ষকদের বস ভাবেন, সচিবালয়ে যারা আছেন তারাও সেটাইভাবে আসলে শিক্ষকদের কোন বস থাকতে পারে না”।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া মানসিকতার কাছে দাস মনিবের পার্থক্য আছে উল্টো পথে। এটা জ্ঞান আর চেতনার দৈন্যতা ছাড়া আর কিছুই নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতার ছত্র ছায়ায় এদেশে আমলাতন্ত্রের বিকাশ অনেকটা সাম্রাজ্যবাদী যুগের মতই, আর এখানেই যত সমস্যা নতুন দেশে পুরনো কালচার। পাকিস্তান পর্বে আমলাদের যে মেজাজ , মনন ছিল তার পুণরাবৃত্তি ঘটছে বারে বারে। দেশের সবচেয়ে মেধাবীরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হয় তবে, সেরা মেধাবীরা অবশ্যই নয়। তবে যাদের টাকায় তার বেতন হয় তাদের গুরুত্ব না বোঝার মত মেধা তাদের নেই এটা অবান্তর। প্রত্যেক সরকারি কর্মচারীকে তা দায়িত্ব হস্তান্তরের আগে শপথ বাক্য পাঠ করানোর সময় এটা স্পষ্ট করে বলা হয় যে দেশের প্রকৃত মালিক জনগণ। তারা সেবক মাত্র । এই সেবক যখন মনিব সাজতে যায় তখনই দেখা দেয় যত বিপত্তি। কিন্তু কেন এমন হলো। প্রশাসন ও রাজনীতিতে যা হয়েছে আগে তা হয়নি, আগে রাজনীতিতে ভুল হলে জনগণ, প্রশাসন, সমালোচনা করে তাদের সঠিক পথে চলতে সহায়তা করত। প্রশাসনে ভুল হলে রাজনীতিবিদরা সমালোচনা করত আর এখন নীতি নির্ধারক আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা একে অন্যের সমালোচনার বিপরীতে সহযোগিতার মানসিকতা ফুটে উঠেছে। এক অদৃশ্য আঁতাতে তাদের মধ্যে এই অতিরঞ্জিত ক্ষমতা চর্চা সমীহ জাগানিয়া অভিপ্রায় দেখা দিয়েছে। প্রশাসন মনে করে তারা সব পারে, তারা জনগণের বস, জনগণ তাদের কাছে নস্যি। আধুনিককালের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মেকিয়াভেলি যথার্থই বলেছেন মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই স্বার্থপর, অর্থ, ও ক্ষমতালিপ্সু। কিন্তু ক্ষমতা, ও টাকার মধ্যে যে একটা নিজস্ব গরম আছে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের তথাকথিত আমলাদের অবস্থা এখন সেটাই মনে হচ্ছে। প্রশাসকদের সামাজিক দাপটের এই প্রাদুর্ভাব কে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মন্জুরুল ইসলাম নেতিবাচক ভাবেই দেখেছেন। তার ভাষ্যমতে চারিদিকে শুধুই প্রশাসক আর প্রশাসক। ক্ষমতা প্রদর্শন আর অর্থের দখল নেওয়ার সমূহ সুযোগই তৈরি করেছে এই প্ল্যাটফর্ম। তাহলে যে পরিমাণ মেধা প্রজ্ঞা আর ধীশক্তি থাকলে ওয়েলফেয়ার স্টেস্টে প্রশাসন যন্ত্র জনমুখি হয় এটা কি তাহলে তাদের মধ্যে কমতি দেখা দিয়েছে! আধুনিককালের রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধারণাকে কেন্দ্র করে। এখানে রাষ্ট্রের জন্য জনগণ নয়, বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস নয়। এটা আমাদের রাষ্ট্র, সামাজিক রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্র জনগণের। জনগণই এখানে ক্ষমতার মূল উৎস। আর এই দর্শন বাস্তবায়নের জন্য ঔপনিবেশিক মাসসিকতা পরিবর্তন করে নতুন করে নির্মাণ করাটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। জয় হোক জনগণের জয় হোক সকল শুভবোধের।
গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষা গবেষক
ডিএসএস/