অপরাধ দমনে মানবিক জ্ঞানবোধ জাগরণ জরুরি
অপরাধ হলো দেশ ও সমাজের শান্তি রক্ষার্থে প্রণীত আইন পরিপন্থী কর্ম। অপরাধের ফলে ব্যক্তিকে অপরাধের মাত্রাভেদে শাস্তি স্বরূপ দণ্ডবিধি আইন-১৮৬০ অনুযায়ী কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড আবার ক্ষেত্রমত মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়। এই শাস্তিদানের উদ্দেশ্য নিয়ে নানাবিধ মতবাদ রয়েছে।
প্রতিরোধাত্মক মতবাদ: এই মতবাদ আলোকে সমাজকে শিক্ষা দান করাই শাস্তির উদ্দেশ্য। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হয় কারণ শাস্তির নির্মম কঠোরতা মানুষকে অনুরূপ অপরাধ করা থেকে নিবৃত্ত করতে পারে। এই শাস্তিতত্ত্বে ভীতি থাকে, যা নৈতিকতার ভিত্তি হতে পারে না।
প্রতিশোধাত্মক মতবাদ: প্রত্যেক মানুষকে নিজস্ব ঐচ্ছিক ক্রিয়ার জন্য দায়িত্ব বহন করতে হয়। তাই প্রত্যেক অপরাধীকে তার অপরাধের দায় বহন করতে হয়। এই মতবাদে একজন অপরাধী সমাজে যতটা ক্ষতিসাধন করেছে তাকে তার সমানুপাতিক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এই মতবাদে ‘খুনের বদলে খুন’ সূত্র বিদ্যমান। এই নীতিতে অপরাধ ও শাস্তির মধ্যে সমানুপাতের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। অপরাধ প্রতিশোধাত্মক হওয়ার চেয়ে দৃষ্টান্তমূলক হওয়া যেতে পারে। প্রতিশোধ নেশা মানুষকে অন্ধ বানিয়ে দেয় কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিতে পরবর্তীতে একই অপরাধ কমে যাওয়ার আভাস পাওয়া যায়। সমাজে অপরাধ কর্মের পথ বন্ধ হওয়া সত্ত্বেও অপরাধ কর্ম মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। বিভিন্ন ধর্মেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান রয়েছে।
সংশোধনাত্মক মতবাদ: সংশোধনাত্মক শাস্তিতত্ত্বে বলা হয় যে, অপরাধীকে সংশোধন করাই শাস্তিদানের উদ্দেশ্য। সমাজবিজ্ঞনীদের মতে, মানুষের মধ্যে নীতিবোধ সুপ্ত থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে মানুষ নৈতিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়। শাস্তি মানুষের সুপ্ত নৈতিকতাকে জাগ্রত করতে সহায়তা করে। তবে যার মধ্যে অশুভ ধারণা দীর্ঘদিন যাবত প্রতিষ্ঠিত থাকে তাকে সংশোধন করা অসম্ভব প্রায়। সংশোধনাত্মক শাস্তিতত্ত্ব আপাত দৃষ্টিতে অপরাধ দমন করলেও প্রকৃত অর্থে অপরাধ নির্মূলে অকেজো প্রায়।
শাস্তি নিয়ে উপরোক্ত মতবাদগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শাস্তি তথা দণ্ডদান সাময়িকভাবে অপরাধ নিবারণ করে মাত্র। বাংলাদেশের সকল জেলায় জেলা দায়রা আদালত রয়েছে ও মহানগরীগুলোতে রয়েছে মহানগর জজ আদালত এবং এই দুই শ্রেণির আদালতের অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি আর হাইকোর্টে মামলা ছিল ২ হাজার ৯১৯ টি। বর্তমানে জনসংখ্যা আড়াই গুণ বেড়ে প্রায় ১৮ কোটি হয়েছে আর অপরাধ বিষয়ক মামলা হাইকোর্টেই বেড়েছে শত গুণের বেশি। হাইকোর্টে বর্তমানে প্রায় ৪ লাখ মামলা জড়ো হয়েছে। ২০১৯ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় “দিনে ১২৯ ফৌজদারি মামলা “ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। বর্তমানে মামলার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মামলার বৃদ্ধি পাওয়া থেকেই অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়।
২০১৯-২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩১ বছরে হত্যা ও সন্ত্রাস বিরোধী অপরাধের মামলায় ১০১ জন আসামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। বর্তমানে বিভিন্ন কারাগারে প্রায় ১ হাজার ৬৫০ জন আসামি তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অপেক্ষার প্রহর গুণছে। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীদের ৭৪ শতাংশ ব্যক্তির অপরাধের সময় বয়স ছিল ৩০ বছরে কম। তাদের মধ্যে ৮৭ শতাংশ স্কুল পার হতে পারেনি এবং ১৫ শতাংশ ব্যক্তির কোনোরূপ প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান ছিল না।
আমরা দেখি, অপরাধ দমনে শাস্তিতত্ত্বের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ঘটার পরেও অপরাধ জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং হলফ করে বলা যায়, অপরাধ নির্মূলে শাস্তি তথা দণ্ডদান একমাত্র উপায় হতে পারে না। অপরাধের পথ খোলা রেখে শাস্তি দেয়ায় কোনো ফল নেই; বরং অপরাধ যেন সংঘটিত না হয় তার জন্য প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা করা জরুরি। যেমন সামাজিক দ্বন্দ্ব-কলহের অবসান ঘটলে নিশ্চয়ই খুনখারাবি রোধ হবে। সম্পদের সুষম বন্টন হলে চুরি ডাকাতি রোধ হবে। নারী পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা ও যৌনপ্রবৃত্তি উদ্দীপক সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে নিষেধাজ্ঞা জারি হলে ধর্ষণ, পরকীয়া ও ব্যভিচার রোধ হবে। তেঁতুল সামনে থাকলে যেমন জিহ্বে জল আসবেই তেমনি অপরাধের পথ খোলা থাকলে অপরাধ সংঘটন হবেই।
অপরাধ নির্মূলে ব্যক্তির মধ্যে প্রথমত মানবিক বোধ সৃষ্টি করতে হবে। অনেকেই ধর্মীয় বোধের ও ধর্ম চর্চার কথা বলে থাকেন। আমি চিরাচরিতই প্রথমত মানবিক বোধ জাগরণকেই প্রাধান্য দিব। কেননা যদি বিশেষ ধর্মের কথা বলি তাহলে ঐধর্মের লোক ব্যতিত সকল মানুষ উক্ত বক্তব্যকে এড়িয়ে চলবে। বিশেষ ধর্মের মানুষকে অপরাধ থেকে বিরত রাখলেই সমাজে অপরাধ বন্ধ হবে না। কেননা সমাজে সকল ধর্মের মানুষ বসবাস করে। মানুষে মানুষে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভেদ থাকতে পারে কিন্তু মানুষ হিসেবে মানবিকতার বিভেদ থাকতে পারে না। মানবিক বোধ সম্পন্ন কোনো মানুষ সেচ্ছায়-স্বজ্ঞানে অন্যায় করতে পারে না। মানবতা হচ্ছে মানুষের ধর্ম। মানুষের জন্য ভালোবাসা, মানুষের জন্য সমবেদনা, স্নেহ-মমতার নামই মানবতা। নিঃস্বার্থভাবে কল্যাণকর কাজে অংশীদার হওয়ার নাম মানবতা। মানবতায় মানুষের ধর্ম, জাত, বর্ণের ভেদাভেদ থাকে না। মানবতা সহজ ও সাবলীল। মানবিক হতে অর্থের প্রয়োজন হয়না;প্রয়োজন নির্ভেজাল মন ও উপলদ্ধির।
রাস্তায় চলতে গিয়ে অন্ধ, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দেওয়া হলো মানবতা। বৃদ্ধ রিকশাচালকের সঙ্গে দামাদামি না করে উপযুক্ত ভাড়া ও পারলে দু’চার টাকা বাড়িয়ে দেয়ার নাম মানবতা। শত্রুর বিপদে খুশী না হওয়া মানবতা। বিধবাকে বিধবা না বলা, ডিভোর্সীকে এড়িয়ে না চলা, অন্ধকে অন্ধ না বলা, প্রতিবন্ধীকে প্রতিবন্ধী নামে না ডাকা, কাজের লোকদের সঙ্গে তুমি সম্বোধন না করাই মানবতা। ব্যক্তির মধ্যে এই মানবতাবোধ জাগ্রত করতে পারলেই কেবল অপরাধ নির্মূল হবে।
অপরাধ নির্মূলে ব্যক্তির মধ্যে দ্বিতীয়ত ধর্মীয় জ্ঞানবোধ জাগ্রত করতে হবে। মানবতা ধর্মবেষ্টিত শুদ্ধিঘর। ধর্ম থেকেই মানবতার সৃষ্টি। ধর্মীয় জ্ঞানে ও ধর্মীয় গুণে গুণান্বিত ব্যক্তি কখনো অপরাধে জড়াতে পারে না। পোপ প্রান্সিস চিরাচরিতই তার অনুসারীদের ধর্মের শিক্ষা ও ধর্ম পালনের তাগিদ দিয়ে থাকেন। ইসলাম ধর্মে ধর্মীয় জ্ঞানার্জনকে সর্বোচ্চ সম্মান দেওয়া হয়েছে। দার্শনিক কাল মার্ক্স ধর্মকে আফিম বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি এজন্যই আফিম বলে মন্তব্য করেছেন যে, মানুষ ধর্মের জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে। মানুষ সব বিসর্জন দিতে পারে কিন্তু ধর্ম বিসর্জন দেয় না। মানুষ ধর্মকে কেন্দ্র করে নিজেকে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ধর্মের প্রতি মানুষের অগাধ আস্থা ও বিশ্বাসের কারণেই কাল মার্ক্স ধর্মকে আফিম বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি যে উদ্দেশ্য নিয়েই এই মন্তব্য করেন না কেন আমি কাল মার্ক্সের এই মন্তব্যকে শ্রদ্ধা জানাই। কেননা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির নিকট নিজ জীবনের চেয়েও ধর্মের মূল্য বেশি। যেহেতু মানুষের কাছে ধর্মের মূল্যমান অমূল্য সেহেতু মানুষের মধ্যে ধর্মের জ্ঞান ও ধর্মের চর্চাকে বাড়াতে হবে। পৃথিবীর কোনো ধর্মই মানুষকে অপরাধী বানায় না। ধর্মের মূলমন্ত্রই হলো মানবতা। সত্য প্রতিষ্ঠায় ধর্ম সর্বদা সোচ্চার। কোনো ধর্মই অন্যায়কে সমর্থন করে না। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ইসলামসহ সকল ধর্মই শান্তির বার্তা দেয়। সকল ধর্মের বিধিবিধান ও আচার মানুষকে কল্যাণ ও সত্য সুন্দরে নির্দেশনা দেয়। শিখায় ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি। ধর্মীয় জ্ঞানবোধ সম্পন্ন কোনো ব্যক্তি সচরাচর অপরাধে জড়িত হওয়ার নজির পাওয়া যায় না।
সর্বোপরি বলা যায়, শাস্তিতত্ত্বের প্রতিরোধাত্মক ও প্রতিশোধাত্মক মতবাদ কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় তবে সংশোধাত্মক মতবাদ গ্রহণ করা যায়। সংশোধাত্মক মতবাদ প্রয়োগের পাশাপাশি মানবিকতাবোধ ও ধর্মীয় জ্ঞানবোধ জাগরণ করলেই কেবল অপরাধ নির্মূল হবে। নচেৎ অপরাধ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তেই থাকবে।
মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
এসএ/