আদালত পাড়ার স্মৃতিময় আলাপন
একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে এক বা একাধিক সংসার থাকে। সেই সংসারের সব সদস্যকে ভালো রাখতে দেখভাল করার দায়িত্বটা কর্তার উপরই বর্তায়। আর একজন আইনজীবীর ব্যক্তিগত জীবন বলতে তেমন কিছু থাকে না। তার পেশাগত জীবনটাই ব্যক্তিগত জীবনে পরিণত হয়। আইনজীবীর যত ক্লায়েন্ট ঠিক ততটাই তার পরিবার। মামলার শুনানিতে আইনজীবীকে ক্লায়েন্টের সত্তা হয়ে ক্লায়েন্টের বক্তব্য উপস্থাপনায় 'আমি' শব্দ উচ্চারণ করতে হয়। এই ‘আমি’ শব্দই প্রত্যেক ক্লায়েন্টের পরিবারকে ভালো রাখার গুরু দায়িত্ব পরোক্ষভাবে আইনজীবীর উপরই বর্তায়।
আইনজীবী সবাইকে ভালো রাখতে গিয়ে নিজেকে ভালো রাখার কথাই ভুলে যান। রাত তিনটা বাজলেও ক্লায়েন্ট ফোন দিয়ে দুঃখের গল্প শোনায়। শোনায় নির্মমতার ইতিহাস। করুণ কাহিনি শুনে আইনজীবীর রাত যায় নিন্দ্রাহীন। আবার যখন ক্লায়েন্ট যত্রতত্র ফোন দিয়ে, মেইল করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সুখের সংবাদ দেয় তখন আইনজীবীর সেই মুহূর্তটা হয় স্বর্গীয়ক্ষণ।
সর্বশেষ গত ২৪ জানুয়ারি ছিল আমাদের মহাকাব্যিক দিন। সন্তানের কাস্টডি ও শরীরের অভিভাবকত্বের মোকদ্দমায় প্রতিপক্ষ তথা বাদীকে জেরা করতে গিয়ে বেরিয়ে এল এক অবলা মেয়ের আর্তনাদের গল্প। ফুটে উঠল ষণ্ডা প্রকৃতির বহু নারীতে আসক্ত এক কুখ্যাত পুরুষের ব্যক্তি চরিত্র। চরিত্রহীনা বলে স্ত্রীকে মারধর করে তাড়িয়ে দেন। আবার মামলাকারী স্বামী নিজেই যখন জেরায় স্ত্রীকে সতীসাধ্বী বলে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন এবং মোকদ্দমার আরজি থেকে স্ত্রীর নামের সঙ্গে চরিত্রহীনাসহ ইত্যাদি নেতিবাচক শব্দ মুছে দেওয়া হয়, তখন সেই ভুক্তভোগীর সঙ্গে আমাদের চোখেও আনন্দ জল নিয়ে আসে।
সন্তান জন্মদানে শুক্রাণু দিয়ে সহযোগিতা করলেই যে বাবা হওয়া যায় না তার জলজ্যান্ত উদাহরণটুকুও দেখার সুযোগ হয়েছে। সন্তানের জন্ম থেকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় এমনকি তার পরবর্তী সময়েও পিতা হিসেবে খোঁজ না নেওয়াটা কেমন পিতার বৈশিষ্ট্য তা সংজ্ঞায়ন করার শব্দাবলী অভিধানেও পাওয়া মুশকিল। মাঝেমধ্যে দূরের লোক থেকে সন্তানের খোঁজ নেওয়া সেই বাবা যখন আবার সন্তানের কাস্টডি ও শরীরের অভিভাবকত্বের দাবি করে মোকদ্দমা দায়ের করেন তখন বিষয়টি শিশুকিশোর মাসিক পত্রিকা কিশোরকণ্ঠের হাসির বাক্সে পরিণত হয়।
লার্নেড সিনিয়র যখন জেরায় বাদীকে তথা স্বামীকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা আপনি আপনার স্ত্রীকে চরিত্রহীনা বলে দাবি করেছেন এবং তাহা বলিয়া মামলাও দায়ের করেছেন, তো আপনি কীভাবে শিউর হলেন এই সন্তান আপনার? যেহেতু আপনার স্ত্রী চরিত্রহীনা সেহেতু এই সন্তান তো যার-তার হতে পারে। এই প্রশ্নে চরিত্রহীনা দাবিকারী স্বামী যেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছেন তেমনি কোর্টে উপস্থিত প্রত্যেক আইনজীবীও শিউরে উঠেছেন।
প্রশ্নের উত্তরে মিথ্যুক স্বামী খুব সাধারণভাবেই স্বীকার করে নিয়েছেন তাহার স্ত্রী সতীসাধ্বী আর এই সন্তান তাহার ঔরসে এবং তাহার স্ত্রীর গর্ভে জন্মে নিয়েছেন। বিচারক জেরার প্রশ্ন ও উত্তরের নোট নিতে গিয়ে আবেগী হয়ে তাকিয়ে ছিলেন আনমনা। বিজ্ঞ বিচারক লার্নেডের বরাবরে সন্তুষ্টির দৃষ্টিতে ঝলক তাকিয়ে ছিলেন। কীভাবে এক প্রশ্নেই মোকদ্দমার সত্যতা বেরিয়ে আসল তাই ভাবছিলেন উপস্থিত জনতা। সেই এক প্রশ্নেই মোকদ্দমার গ্রাউন্ড হারিয়ে গেল। মোকদ্দমা সম্পূর্ণ রূপে বিবাদী তথা অবলা স্ত্রীর অনুকূলে স্থান নিল। এখন শুধু চূড়ান্ত রায় শোনার অপেক্ষায়। তবে তার জন্য আদালতের নিয়মতান্ত্রিকতায় ব্যয় সময়টুকু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
২৪ জানুয়ারি আদালতে ব্যয় সময়টুকু আমার স্মৃতির জগতে সর্বদা চেতন হয়ে থাকবে। বারবার মনে পড়বে বিচারকের কিংকর্তব্যবিমূঢ় আবেগী হয়ে থাকা চেহারাটুকু। সম্মুখে ভেসে আসবে স্বামীর চোরা চোরা ভাবের মুখ অবয়ব ও বাদী পক্ষের আইনজীবীর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দৃশ্য। স্মৃতিপটে আসবে ভেসে ভুক্তভোগী স্ত্রীর উজ্জ্বল চেহারাখানা এবং দর্শকের সন্তুষ্টির হাসি।
এসএন