আর্টিজান হামলা
পায়ের দিকে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি শুধু রক্ত আর রক্ত
আজ (১ জুলাই) শুক্রবার হলি আর্টিজান হামলার ৬ বছর পূর্ণ হলো। ৬ বছর হয়ে গেলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বর্বর কাহিনী এখনও ভুলেনি কেউই। ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় ঢুকেই জঙ্গিরা জিম্মি করে ফেলে অবস্থানরত সবাইকে। জিম্মির এ ঘটনা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। তবে ঘটনার ভয়াবহতা তখনো আঁচ করতে পারেনি কেউ। তবে প্রথম অভিযানেই যখন পুলিশের দুই কর্মকর্তা মারা যায় আর ২৫ জন পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি হয়। ভয়াবহ এ হামলায় নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এবং প্রায় ১২ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস জিম্মি সংকটের ঘটনা স্তম্ভিত করেছিল পুরো জাতি, পুরো বিশ্বকে। সেদিনের জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ মোট ২২ জন নিহত হন।
জঙ্গি হামলার ওই সময় আমি গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) হিসেবে কর্মরত ছিলাম। গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় ফাস্ট রেসপন্সন্ডারদের একজন মানুষ আমি। দুই পায়ে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার আগ পর্যন্ত জঙ্গিদের প্রতিরোধ করে গেছি। এটি দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে নারকীয় ও বড় জঙ্গি হামলার ঘটনা।
হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন সেই রাতের নারকীয় জঙ্গি হামলা নাড়া দিয়েছিল গোটা দেশ তথা সারা বিশ্বকে। নারকীয় ওই জঙ্গি হামলার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বাংলাদেশ পুলিশ। এ ঘটনায় আহত হয়েছিলেন ৩৬-৩৭ জন পুলিশ সদস্য।
হঠাৎ ওয়ারলেসে খবর আসে গুলশানে গোলাগুলি হচ্ছে। ঘটনার দিন ইফতার শেষ করে অফিসে বসে চা খাচ্ছিলাম। চা শেষ হওয়ার আগেই আনুমানিক রাত প্রায় ৯ টার দিকে ওয়ারলেস সেটে শুনতে পাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে গোলাগুলি হচ্ছে। খবর পাওয়া মাত্রই ঘটনাস্থলে যেতে সময় লেগেছিল ৫-৬ মিনিট। তখন হামলার বিষয়টি আমার ডিসি স্যার মোস্তাক আহমেদ ফোনে তৎকালীন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ও ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া স্যারকে জানান। পরে পুলিশের বেশ কয়েকটি ইউনিট আসে। এরপর আমরা বেশ শক্তি পেয়ে যাই।
ওই দিন আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগে ইউনাইটেড হাসপাতালের পাশে থাকা গুলশান থানার একটি মোবাইল টিম সেখানে পৌঁছায়। একজন উপ-পরিদর্শকের (এসআই) নেতৃত্বে মোবাইল টিমটি হলি আর্টিজানের সামনে যাওয়া মাত্রই তাদের লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীরা গুলি ছুড়তে থাকে। সন্ত্রাসীদের গুলির জবাবে মোবাইল টিমের সদস্যরাও গুলি ছোড়ে। এরই মধ্যে ওই মোবাইল টিমের দলনেতা হলি আর্টিজানের প্রধান ফটকটি বাইরে থেকে বন্ধ করে দেন, যাতে সন্ত্রাসীরা বের হয়ে যেতে না পারে। গুলি বিনিময়ের একপর্যায়ে ওই এসআই গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাকে দ্রুত উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ঘটনাস্থলে পৌঁছে আমরা শুনতে পায় প্রচুর গোলাগুলির শব্দ বিভিন্ন আওয়াজ আসছিল হলি আর্টিজানের ভেতর থেকে। গোলাগুলির শব্দ শুনে আমাদের মনে নানা ধরনের সন্দেহ জাগছিল। তখনও আমরা নিশ্চিত ছিলাম না যে এটি জঙ্গি হামলা কি না। আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আমাদের একাধিকবার গুলি বিনিময় হয়। তারা বাইরে বের হতে চেয়েছিল, কিন্তু আমাদের প্রতিরোধের কারণে তারা বের হতে পারেনি।
প্রাথমিক ধারণা ছিল হয়তো ছিঁচকে সন্ত্রাসীদের ঘটনা। পরে খবর আসে ভেতরে কিলিং মিশন চলছে। তারা যাকে পেয়েছে তাকে হত্যা করেছে। ভিতরে যে পরিমাণ গুলির শব্দ ও চিৎকারের শব্দ পাচ্ছিলাম তাতে মনে সন্দেহ তৈরি হয় যে এটি হয়তো বড় কোনো সন্ত্রাসী কিংবা জঙ্গি হামলা। তখন আমরা আরও পুলিশ সদস্য পাঠানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাই। হামলা শুরুর ৪০-৫০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে হাজির হন র্যাব ডিজি ও ডিএমপি কমিশনার। হলি আর্টিজানে হামলা শুরুর ৪০-৫০ মিনিটের মধ্যে তৎকালীন র্যাব ডিজি ও বর্তমান আইজিপি স্যার এবং তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার স্যার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে পুলিশ ও র্যাবের বড় একটি ডিপ্লয়মেন্ট হয়ে যায়।
যখন ডিএমপি কমিশনার স্যারকে হামলার বিষয়ে ব্রিফ করছিলাম তখন এক গাড়িচালক দৌড়ে এসে আমাদের বলে, স্যার ভেতরে অনেক মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। জানতে চাইলাম, তিনি কীভাবে জানলেন? তখন সে আমাদের বলে, ভেতরে তার এক পরিচিত গাড়িচালক আছে। সে বিদেশি এক নাগরিকের গাড়ি চালায়। ওই গাড়িচালক হলি আর্টিজানের খাবারের টেবিলের নিচে লুকিয়ে থেকে মোবাইল ফোনে বাইরে থাকা চালককে বলে, সন্ত্রাসীরা গুলি করে অনেক মানুষকে মেরে ফেলছে। তখন আমরা মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারি যে এটা জঙ্গি হামলা হতে পারে।
এদিকে আমরা জানতে পারি টিভি স্ক্রলের মাধ্যমে জঙ্গিরা আমাদের অবস্থান জানতে পারে। ডিএমপি কমিশনার স্যার ঘটনাস্থলে আসার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে একদিকে মাইকিং করে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানো হয়।
অন্যদিকে হলি আর্টিজানের সামনে কমিশনার স্যারকে মাঝে রেখে আমরা নানা প্ল্যান করছিলাম কীভাবে ভেতরে ঢুকে জঙ্গিদের প্রতিহত করা যায়। আমাদের এ অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন টিভিতে স্ক্রল যাচ্ছিল। জঙ্গিরা হলি আর্টিজানের ভেতরে থাকা টিভি দেখে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। অবস্থান নিশ্চিত হয়েই জঙ্গিরা আমাদের লক্ষ্য করে একাধিক গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। গ্রেনেডগুলো ঠিক আমাদের পেছনে এসে পড়ে।
গ্রেনেড নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে শুধু শব্দ আর শব্দ। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি দেখি তৎকালীন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাউদ্দিন রাস্তায় পড়ে গেছেন। একটু দূরে ডিবির সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) রবিউলও পড়ে রয়েছেন। আমার পায়ের দিকে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি শুধু রক্ত আর রক্ত। এর পরই আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। চোখ খুলে দেখি আমি ইউনাইটেড হাসপাতালে। ঘটনাটি মিনিটের মধ্যে ঘটেছিল। আমার মনে পড়ে ওই হামলায় আমরা তখন ৩৬-৩৭ জন স্প্লিন্টার বিদ্ধ হই। দুজন স্পট ডেথ।
এ ঘটনা বারবার আমাকে নাড়া দেয় এবং ওসি সালাউদ্দিনের একটি কথা মনে পড়ে, 'স্যার আমি কিন্তু আপনার পেছনে।' সালাউদ্দিন আর এসি রবিউল আজীবন পিছনেই থেকে গেলে। এমন ঘটনা যাতে আমাদের দেশে আর কখনও না ঘটে সেই প্রার্থনাই করি।
আ. আহাদ, মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি)
কেএম/এনএইচবি/এএস