দেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের কদর
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। সেই নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে তা নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভিন্ন মত।
আওয়ামী লীগ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীন। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
অন্যদিকে বিএনপি বলছে, বর্তমান সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিএনপি কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।
এই অবস্থায় দেশের রাজনীতিতে গত কিছুদিন ধরেই তৎপরতা বেড়েছে বিদেশি কূটনীতিকদের। বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোর নেতারা প্রায় দিনই যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। যোগাযোগ রাখছেন নিয়মিত।
এই সুযোগে বিদেশিরা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ করে তুলছেন। আগামী নির্বাচন ইস্যুতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে বেশি সরব ঢাকায় নিযুক্ত কূটনৈতিকরা। তারা যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের আমন্ত্রণে তাদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, তেমনি রাজনৈতিক নেতাদেরও ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের বাসা-অফিসে। শুধু রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গেই নয় বরং সুশীল সমাজ, ব্যবসায়িক সংগঠন, নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গেও কূটনীতিকরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন, বৈঠকও করছেন।
রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোকে কাছে টানতেই রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যদিও এই ধরনের প্রতিযোগিতা এবারই নতুন নয়। দেশের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেওয়ার ঘটনা আগেও ছিল। রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতা ধরে রাখার প্রতিযোগিতার কারণেই বিদেশিদের হস্তক্ষেপ বেড়েছে দেশের রাজনীতিতে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। ইসি সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। ইসির অধীনেই হবে নির্বাচন। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা দূতাবাসের কূটনৈতিকদের এ বিষয়ে সজাগ করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে সূত্রগুলো। তবে কূটনীতিকরা চাইছেন সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচন।
বিএনপির কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল ভারতীয় হাইকমিশনের সঙ্গে দেখা করতে গেলে আগামী নির্বাচন ও আন্দোলন সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান জানতে চেয়েছে ভারতীয় হাইকমিশনার। সেখানে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি না জানতে চাইলে দলটির নেতারা সাফ জানিয়ে দেন— দলীয় সরকার বিশেষ করে শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বিএনপি। বরং যত দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা না হবে, তত দিন শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবে বিএনপি।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায়ে ক্ষমতাসীনদের প্রতি রাজপথ আন্দোলনের পাশাপাশি বিদেশি চাপ সৃষ্টি করতে এবার কূটনৈতিক লড়াইয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিদেশে বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে কূটনৈতিক লড়াই চালাচ্ছেন বিএনপির হাইকমান্ড নিজেই। আর ঢাকায় অনেকটাই ভিন্ন কৌশলে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বিএনপির কূটনৈতিক কোরের সদস্যরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচন ইস্যুতে গড়ে উঠা সাপে-নেউলে সম্পর্কের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন কূটনৈতিকরা।
সংশ্লিষ্টদের বলছেন, দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ না পাওয়ায় ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশায় বিদেশিদের সহায়তা চাওয়া এখন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা বরাবরই বিদেশিদের তৎপরতার বিরোধিতা করেন। আর যারা ক্ষমতার বাইরে থাকেন তারা বিদেশিদের সহায়তা চান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষক কমিটির একজন সদস্য ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক নেতাদের কূটনীতিকদের কাছে দৌড়ঝাঁপ নতুন নয়। বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আওয়ামী লীগ বেশি দৌড়ঝাঁপ করেছে। এখন হয়ত বিএনপির দৌড়ঝাঁপ কিছুটা লক্ষণীয় হয়ে উঠছে। কারণ ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে অবগত। এখন তারাও জনগণের প্রতিনিধিকে ক্ষমতায় দেখতে চাচ্ছেন।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিক দলগুলোকেই সমাধান করতে হবে। অন্যথায় ২০০৫ সালে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে যে রাজনৈতিক বিরোধ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে সেটা আবারো দেখা যাওয়ার শঙ্কা থাকছে। নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বাংলাদেশের রাজনীতি আর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকসহ প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে বড় দলগুলোর যোগাযোগ বেড়ে যায়। কখনো কখনো তাদের উৎসাহী অবস্থান কূটনীতিকদের নাক গলানোর সুযোগ করে দেয়। সাম্প্রতিক সময়েও একই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, বিএনপি নেতাদের বিদেশিদের কাছে দৌড়ঝাঁপ প্রমাণ করে তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কত নাজুক। দলটি এখন দেশের নির্বাচনে বিদেশিদের প্রভাব কাজে লাগানোর চেষ্টায় ষড়যন্ত্র করছেন।
এদিকে গত কয়েক মাস ধরে ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছেন। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নির্বাচন ইস্যুতে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে কখনো নিজেদের বাসায় আবার কখনো হোটেলে নিয়ে বসছেন প্রভাবশালী দেশের হাইকমিশনাররা।
সর্বশেষ গত ২২মার্চ দুপুরে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের আমন্ত্রণে তার বাসভবনে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নিয়েছে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে নেতারা এতে অংশ নেন।
এনএইচবি/আরএ/