গণতন্ত্র মঞ্চের সরকার পতন আন্দোলনের রূপরেখা ২৮ জুলাই
নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের ভারসাম্য, নির্বাচন, দেশের আর্থ সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট উত্তরণসহ বেশ কিছু ইস্যুতে দাবি আদায়ে জোটবদ্ধ হয়েছে সরকারবিরোধী সাতটি রাজনৈতিক দল। ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন এই জোটের নেতারা। আগামী ২৮ জুলাই এই জোটের পক্ষ থেকে একটি রুপরেখা তুলে ধরার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নতুন এই জোটে রয়েছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। যদিও ওই সাতটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে জেএসডি ছাড়া কারো নিবন্ধন নেই। এই নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গণে চলছে নানা গুঞ্জন।
কারণ আ স ম আবদুর রবের জেএসডি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গণফোরামের ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে তোলা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক ছিল। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বর্তমানে বিলুপ্ত। ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন সম্প্রতি নিজেই বলেছেন ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট অকার্যকর, এটি আর নেই'।
এছাড়া যে সাতটি রাজনৈতিক দল এই জোট গঠন করেছে এদের মধ্যে চারটি দল বিএনপির পুরনো মিত্র। আর দু'টি দল নতুন মিত্র। ফলে বিএনপি যে মুহূর্তে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে, ঠিক তখনই এই মঞ্চ নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি করবে বলে মনে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
জোট সম্পর্ক জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমরা মনে করি সাংবিধানিকভাবে কিছু প্রস্তাব তুলে ধরা দরকার। সংবিধানের ৭/৮ টি সংশোধনী তুলে ধরে গণতন্ত্র মঞ্চের রুপরেখা প্রকাশ করা হবে। যার মধ্যে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের ভারসাম্য, অর্থাৎ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কমানো, নির্বাচন ও নির্বাচনের প্রস্ততির বিষয়েও প্রস্তাবনা থাকবে। সামগ্রিকভাবে দেশে আর্থ সামাজিক-রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে কিছু দিকনির্দেশনামূলক দাবি থাকবে। সরকার ও সরকারি দলের দম্ভ আর একগুঁয়েমি মনোভাব দেশকে মহাবিপদে ঠেলে দিচ্ছে। গায়ের জোরে ক্ষমতায় থাকতে গিয়ে সরকার দমন করে শাসন করার কৌশল নিয়েছে। শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের যেনতেন ভাবে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার আকাঙ্ক্ষা দেশবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। এর থেকে মুক্তি পেতে এই সরকারকে বিদায় করা সময়ের দাবি।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চের গৃহীত সিদ্ধান্তের প্রতি কোনো রাজনৈতিক দল ও সংগঠন যদি সহমত পোষন করে জোটবদ্ধ হতে চায় তাহলে সেই বিষয়েও সুযোগ থাকছে। মূলত একটা যুগপৎ আন্দোলনের ব্যাপারে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যারা রাজপথে আছে তাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করব। এমনকি ইসলামী দলগুলোর প্রতিও আহ্বান থাকবে। তারা যদি রাজপথে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শরিক হতে চায় তাদেরকে সঙ্গে নিয়েও যুগপৎভাবে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখতে সরকার দেশকে ভয়ংকর বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। আরেকটি ব্যর্থ নির্বাচনের বোঝা দেশের মানুষ বহন করতে পারবে না। ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণকে আন্দোলনে জিততে হবে। সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে গণতন্ত্র মঞ্চ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সমামনা দলগুলো বিএনপির দাবিগুলোর সঙ্গে একমত হলেও এখনই বৃহত্তর ঐক্য হচ্ছে না। সবাই অভিন্ন দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে আগ্রহী। তাই কর্মসূচির ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলাই যুক্তিযুক্ত বলছেন নেতারা। ইতিমধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে একটি ফর্মুলা দেওয়া হয়েছে। সেভাবে দলটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে যাচ্ছে। তবে আন্দোলন কর্মসূচির অবস্থান এখনো চূড়ান্ত রূপ পাচ্ছে না। শুরুতে যার যার অবস্থান থেকে আন্দোলন করা হবে। পরবর্তীতে আন্দোলন দানা বাঁধলে প্রয়োজন হলে এক মঞ্চে আসা যাবে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে এখানে বিবেচনায় রাখছেন নেতারা। তাদের কাছে এই মুহুর্তে এটাই সঠিক পন্থা হবে।
এদিকে গণতন্ত্র মঞ্চের বেশ কয়েকজন নেতা জানান, জোটের ভিত্তি চূড়ান্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে রূপরেখা তুলে ধরার পর ধীরে ধীরে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নামার কৌশল নিচ্ছেন। সেই পরিকল্পনায় মাঠে কর্মসূচি নিয়ে নামার আগে কিছুটা সময় নিতে চান দলটির নেতারা। সরকারবিরোধী সকল রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও দেশ প্রেমিকদের জোটের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হবে। জোটের ভিত্তিতে একমত হলে নতুন করে জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অতীতে অনেক জোট হয়েছে এবারও হচ্ছে। জোটের যেমন ব্যর্থতা আছে তেমনি সফলতাও কিন্তু কম নয়। সেক্ষেত্রে এবার ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ দাবি আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। আমরা যদি শেষ পর্যন্ত আমাদের সিদ্ধান্তে অটুট থাকতে পারি তাহলে একটি কাঙ্খিত ফলাফল আসবেই।
তিনি বলেন, গণতন্ত্রে যদি তিনি (প্রধানমন্ত্রী) ফিরতে চান, তাহলে প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে বিতর্কিত নির্বাচন থেকে সরে আসা ৷ অর্থাৎ এই সংসদ ভেঙে দেওয়া, পদত্যাগ করা এবং ভালো একটি নির্বাচনের জন্য নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করা। তবেই রাজনৈতিক দলগুলোর তাঁর প্রতি আস্থা ফিরে আসতে পারে৷
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল(জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব বলেন, ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে অভিযাত্রা শুরু করেছে। এ মঞ্চ আগামী দিনে গণজাগরণ ও গণঅভ্যুত্থানের সম্ভাবনাকেই অনিবার্য করে তুলবে।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের মহাসচিব শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। তাদেরকে অবিলম্বে পদত্যাগ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
তিনি বলেন, বিএনপি জোট, সাত দলের গণতান্ত্রিক মঞ্চ স্ব স্ব অবস্থানে থেকে পৃথকভাবে যুগপৎ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে।
গণ অধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নুর বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চের কার্যক্রম শুরুর আগেই সরকার ভয় পেয়ে হামলা শুরু করে দিয়েছে। ভয়ভীতি তৈরি করে এই সরকার ক্ষমতায় থাকতে চায় বলে তারা প্রতিনিয়ত সহিংসতা করছে। ছাত্রলীগ যুবলীগ দিয়ে হামলা চালাচ্ছে, ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। কিন্তু এভাবে বেশিদিন ক্ষমতায় থাকা যাবে না। শেখ হাসিনার পতন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করে মসনদের পতন ঘটাবে গণতন্ত্র মঞ্চ।
স্বাধীনতা বিরোধী কেউ আসতে চাইলে তাদের নেওয়া হবে কি-না জানতে চাইলে নুর বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর স্বাধীনতা বিরোধী বলে আর বিভেদ তৈরি করা যাবে না। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিটের সঙ্গে যাদের রাজনীতি সাংঘর্ষিক তাদের আমরা এই জোটে নেব না।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের মহাসচিব শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে রাজপথ আন্দোলনের বিকল্প নেই। গণতন্ত্রণ মঞ্চ খুব শিগগিরই একটি রুপরেখা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরবে।
তিনি বলেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন একটি ২০ দলীয় জোট আছে, ইসলামী দলগুলো জোটবদ্ধ হচ্ছে, আমরাও গণতন্ত্র মঞ্চ একটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটি কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে কৌশল নির্ধারণ পরিকল্পনার ছক আকছে। উদ্দেশ্য সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে একটি যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তোলা। আশা করছি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেই আন্দোলন সফলতার মুখ দেখবে।
এই জোট সম্পর্ক এনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, শুধু মাত্র বিএনপি নয়, বর্তমান সরকার ও সরকার প্রধানের ওপর দেশের কোনো রাজনৈতিক দল, দেশপ্রেমিক, সংগঠন কিংবা জনগণ কারো কোনো আস্থা নেই। ক্ষমতাসীনদের কথা ও দলের মধ্যে গণতন্ত্রের ছিটোফোটা নেই। যেখানে মানুষ কথা বলতে পারে না, আতঙ্কের মধ্যে জীবনযাপন করছে, অনিয়ম ও দুর্নীতির জবাবদিহিতা নেই, আইনের শাসন নেই সেখানে তারা জোর করে ক্ষমতা দখল করে আছে। আগামীতেও ক্ষমতা দখলে রেখে ক্ষমতায় ফিরতে চাচ্ছে সেই মুহুর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর সরকারবিরোধী জোটে কিছুটা হলেও আশার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি।
এদিকে নতুন এই রাজনৈতিক জোটকে কিভাবে দেখছে আওয়ামী লীগ? এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন, নতুন যে কোনো রাজনৈতিক জোটকে আমরা স্বাগত জানাই। গণতান্ত্রিক দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে যে কারও রাজনীতি করার অধিকার আছে। কিন্তু যারা এই জোট করছে তারা আগেও তো এমন জোট করে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিকে সুযোগ দিয়েছে।
এমএইচ/এএস