গণতন্ত্র মঞ্চের তিন দফা দাবি
‘ফ্যাসিবাদী দুঃসময়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ গণসংগ্রাম জোরদার করুন’ ব্যানারে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ।
সোমবার (৮ আগস্ট) দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে গণতন্ত্র মঞ্চের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
সাত দলের সমন্বয়ে গঠিত গণতন্ত্র মঞ্চের তিনটি দাবি হলো-
খ. (১) বাংলাদেশের বিদ্যমান দুঃশাসনে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো অবকাশ নেই। সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নয় বরং তারা আরও একটি একতরফা তামাশার নির্বাচনের ছক তৈরি করছে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে। এই অবস্থায় জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত এবং অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে হবে এবং একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
২. এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজ হবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এ লক্ষ্যে তারা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করবে, প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক রদবদল করবে, একজন নাগরিকের নির্বাচিত করার ও নির্বাচিত হবার অধিকার নিশ্চিত করতে দল নিবন্ধন আইন, নির্বাচন আইন ও বিধিমালার যথাযথ সংস্কার করবে এবং ইভিএম বাতিল করে স্বচ্ছ ভোট বাক্সে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
৩. এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো এবং প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরিতে সহায়তা করবে, যাতে করে পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ গণতান্ত্রিক সংস্কার সম্পন্ন করতে বাধ্য থাকে।
খ. শুধু একটা নির্বাচন অনুষ্ঠানই যথেষ্ট নয় বরং নির্বাচিত হয়ে যে কারোর স্বৈরতন্ত্রী বা ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার বীজ বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধানের ভেতরেই কার্যকর রয়েছে। কাজেই ভবিষ্যতে কারো স্বৈরতন্ত্রী বা ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠা প্রতিরোধে প্রয়োজন নতুন এক গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কার।
১. প্রয়োজন এক ব্যক্তির হাতে জবাবদিহিহীন সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার ব্যবস্থার বদলে রাষ্ট্রের তিন অঙ্গ- সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ও সরকারের জবাবদিহি কার্যকরী ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সাংবিধানিক আদালত প্রতিষ্ঠা এবং নির্বাচন কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক কমিশন গঠনের আইন প্রণয়ন।
২. সংসদ সদস্যদের মতামত প্রদানে অধিকার খর্বকারী বিদ্যমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সরকার গঠনে আস্থা ভোট ও বাজেট পাস রেখে সব বিলে স্বাধীন মতামত প্রদান ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নিশ্চিত করা।
৩. সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার। বর্তমান এককেন্দ্রিক ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তে বিকেন্দ্রিভূত শাসন ব্যবস্থার লক্ষ্যে বিদ্যমান সংবিধানের স্থানীয় শাসনের বিপরীতে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নাগরিক সেবা এবং প্রয়োজনীয় বাজেট প্রণয়ন, কর সংগ্রহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার। একই সঙ্গে ফেডারেল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা বিষয়ে আলোচনার জন্য জাতীয় কমিশন গঠন।
৪. বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নিম্ন আদালতকে নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে তার পরিচালনা ও তদারকি উচ্চ আদালতের হাতে ন্যস্ত করা, প্রধান বিচারপতিসহ বিচারক নিয়োগ ও পদোন্নতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন।
৫. গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ ব্যক্তির মতপ্রকাশ, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পরিপন্থী উপনিবেশিক ও নিবর্তনমূলক সব আইন বাতিল করা; গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক সমাজের উপযোগী আইন প্রণয়ন করা।
৬. মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতিতে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জীবন ও মর্যাদা নিশ্চিত করা। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যার যার অবদানের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান।
৭. অর্থনৈতিক আইন কানুন সংস্কারের মাধ্যমে লুটপাট ও পাচার বন্ধ করে অর্থনীতির উৎপাদনশীল পুনর্গঠনের মাধ্যমে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির টেকসই প্রকৃতিবান্ধব ভিত্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা তৈরি।
গ. এসব রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক ও শাসন কাঠামোগত সংস্কারের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা এমনভাবে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্গঠন করতে চাই যাতে তা জনগণের সর্বাধিক মঙ্গল নিশ্চিত করে।
১. জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গীয় পরিচয় ও শ্রেণি নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ করা; রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও সাম্প্রদায়িক হামলার তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা; গুম হওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা।
২. ‘বিনা চিকিৎসায় কেউ মারা যাবে না’ এই নীতির ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রীয় অংশগ্রহণ বৃদ্ধি ও বেসরকারি খাতে মুনাফার লাগাম টেনে ধরার মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার।
৩. ‘দেশের প্রতিটি শিশুর শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের’ এই নীতির ওপর ভিত্তি করে সবার জন্য একই মানের শিক্ষা নিশ্চিত করা, মাতৃভাষায় শিক্ষাকে অগ্রধিকার এবং শিক্ষাকে জাতীয় উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
৪. উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট কাজে এবং সব নাগরিক সেবা পেতে ঝামেলামুক্ত ‘একটেবিল নীতি’ বা ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ কার্যকর করা। দেশের উদ্যোক্তাশ্রেণির জন্য বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ করা ও এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি। বিদ্যুৎ খাতসহ সর্বত্র দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এবং পরিবেশসম্মত সাশ্রয়ী বিদ্যুতের জন্য বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনা ঢেলে সাজানো।
৫. কৃষকের ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা ও ভূমি ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রকৃতিবান্ধব উৎপাদনমুখী সংস্কারে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান। পাটকলসহ সব বন্ধ কলকারখানা চালুর উদ্যোগ গ্রহণ। শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের জন্য ন্যূনতম মর্যাদাপূর্ণ মজুরি ঘোষণা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠা।
৬. সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুলভে স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ গণপরিবহনের ব্যবস্থা, বাসা ভাড়ার যৌক্তিক সীমা নির্ধারণ। প্রকৃত দরিদ্রদের যথাযথভাবে চিহ্নিত করে তাদের সহায়তা দেওয়া ও বেকারদের/কর্মহীন মানুষের স্ব-কর্মসংস্থানে সহায়তা বা বেকারভাতা প্রদান। বৃদ্ধ বা প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠির জন্য সর্বত্র বিশেষ ব্যবস্থা ও তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। সর্বোপরি সব নাগরিকের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই উন্নয়নের একটি মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
৭. জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জাতীয় ঐক্য ও জনগণের ভূমিকা পালনের কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। সমতা, ন্যায্যতা, পারস্পরিক স্বার্থের স্বীকৃতি ও স্বীকৃত আন্তর্জাতিক বিধিবিধান অনুযায়ী দ্বিপাক্ষিক সমস্যাদির সমাধান করা। সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা পালন।
সাতটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত এ গণতন্ত্র মঞ্চের দলগুলো হলো - জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন।
লিখিত বক্তব্যে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ একটি গণতান্ত্রিক মানবিক ও কল্যাণকামী ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে সাতটি রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রমঞ্চ নামে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা এখন সুস্পষ্ট যে বর্তমান সরকার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পারছে জনসমর্থন বা নিজেদের রাজনৈতিক শক্তির জুড়ে নয় বরং একদিকে রাষ্ট্রশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বইয়ের শাসন তৈরির মাধ্যমে এবং অন্যদিকে রাজপথে জনগণ ও বিরোধী দল সমূহের কার্যকরী গণসংগ্রামের অনুপস্থিতির কারণে। অথচ দেশের মানুষ এখন চায় পরিবর্তনের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও দিশা নিয়ে রাজপথে জনগণের বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। এ কারণে আমরা দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পাশে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক দল শ্রেণি পেশার সংগঠন ও সামাজিক শক্তি সমূহের বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করি।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি বৃহত্তর এই ঐক্যের ভিত্তিতে গণআন্দোলন গণসংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান দুঃশাসনকে বিদায় দিতে না পারলে মানুষের ভোটের অধিকার, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, অবাধ নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনসহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কিছুই অর্জন করা যাবে না।
মান্না বলেন, আমরা জনগণের রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলে দেশে এক নতুন সংগ্রামের সূচনা করতে চাই। আমরা চাই রাজপথে যুগপৎ ধারায় জনগণের বৃহত্তর কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলতে যাতে বর্তমান সরকার ও বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা বদলাতে জনগণের এক ব্যাপক উত্থান ঘটানো সম্ভব হয়। আমরা দেশের জনগণকে এই লড়াইয়ের শামিল হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাই।
এসএন