ঢিলেঢালা হরতালে কিছু উত্তেজনা
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সারাদেশে আধা বেলা হরতাল পালন করেছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এ হরতালে নৈতিক সমর্থন জানায় বিএনপি।
সোমবার (২৮ মার্চ) সকাল ৬টা থেকে শুরু হয়ে এ হরতাল দুপুর ১২টায় শেষ হয়। বাম গণতান্ত্রিক জোটের হরতাল কর্মসূচি কেমন হলো প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যানুযায়ী ঢাকাপ্রকাশের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
রাজধানীতে ঢিলেঢালাভাবে হরতাল পালিত হয়। গাড়ি চলাচল ছিল স্বাভাবিক। দোকানপাট, অফিস-আদালতও যথারীতি খোলা ছিল। এদিকে হরতালে পল্টন মোড়ে পুলিশের সঙ্গে হরতাল সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় হরতাল সমর্থকদের উদ্দেশে পুলিশকে জলকামান ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করতে দেখা গেছে। হরতাল সমর্থকরাও পুলিশের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে। এতে পুলিশের চার থেকে পাঁচজন সদস্য আহত হয়েছেন।
সোমবার দুপুরে পল্টন মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন মিয়া বলেন, বেলা ১১টার দিকে পল্টনে হরতাল সমর্থকেরা অতর্কিতভাবে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এ সময় তাদের বাধা দিতে গেলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ জলকামান নিক্ষেপ করে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করছিলাম। পুলিশ বিনা উসকানিতে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে। জল কামান ও টিয়ার শেল ব্যবহার করা হয়েছে। পুলিশের হামলায় আমাদের বেশকিছু নেতাকর্মী আহত হয়েছেন।
হরতালের সমর্থনে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়েছিল বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো। টায়ার জ্বালিয়ে ও রাস্তার পাশের ব্যানার-পোস্টারে অগ্নিসংযোগ করে ব্যারিকেড তৈরির মাধ্যমে সকাল পৌনে ৭টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত শাহবাগ মোড়ে অবস্থান করেন ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় শাহবাগ এলাকায় তৈরি হয় যানজট। কর্মজীবী মানুষদের অনেককেই এ সময় হেঁটে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।
গণসংহতির প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, হরতালের সমর্থনে সকালে মিরপুরে মিছিল বের করলে পুলিশ আমাদের ৯ নেতাকর্মীকে আটক করে নিয়ে যায়। এছাড়া সারাদেশেও বেশকিছু নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে হরতালে ছিল না প্রাণ
হরতালে চট্টগ্রাম নগরী কিংবা জেলার কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। হরতালের সমর্থনে বাম গণতান্ত্রিক জোটের মিছিল-সমাবেশ এমনকি পাওয়া যায়নি পিকেটিংয়ের খবরও। অন্যদিকে প্রায় সব রাস্তায় তীব্র যানজটে দুর্ভোগে পড়েছে নগরবাসী। অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছে বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ সব ধরনের যানবাহন। চট্টগ্রাম বন্দর থেকেও মালামাল পরিবহন স্বাভাবিক ছিল। সকাল থেকে সবকটি ট্রেন যথাসময়ে চট্টগ্রাম স্টেশন ছেড়ে গেছে। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচলেও হরতালের কোনো প্রভাব নেই। রাস্তায় বেরিয়ে পড়া বেশ কয়েকজন চাকরিজীবী, সবজি বিক্রেতা আর অটোরিকশা চালক জানিয়েছেন, তাদের জানা নেই আজকে হরতাল।
তবে হরতালকে কেন্দ্র করে যেকোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি মোকাবিলায় সতর্ক অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রাস্তায় মোতায়েন ছিল অতিরিক্ত পুলিশ।
রংপুরে নিরুত্তাপ হরতাল
হরতালের কোনো প্রভাব পড়েনি বিভাগীয় শহর রংপুরে। স্বাভাবিক ছিল সবকিছু। নগরীর সব প্রকার দোকান, মার্কেট ছিল খোলা। সড়কে চলেছে যানবাহন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর শাপলা চত্বর, জাহাজ কোম্পানি মোড়, পায়রা চত্বর, মর্ডান, কাচারি বাজার, ধাপ এলাকা ঘুরে দেখা যায়, রংপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে আন্তজেলা রুটে বাস চলাচল করছে। সেই সঙ্গে কামারপাড়া ঢাকা কোচ স্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে দূরপাল্লার বাসও চলছে।
তবে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নগরীর প্রেসক্লাব এলাকা থেকে বাম জোটের নেতা আব্দুল কুদ্দুস, মমিনুল ইসলাম, রাতুল ও তিতুর নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করেছেন। মিছিলটি শাপলা চত্বরে গিয়ে সমাবেশের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) হোসেন আলী জানান, অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে নগরজুড়ে সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ।
সিলেটে ঢিলেঢালা হরতাল
হরতালের কোনো প্রভাব পড়েনি জনজীবনে। সড়কে যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিক। দোকানপাট, মার্কেট, বিপনী-বিতান, শপিংমল সবই খোলা রাখা হয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে হরতাল দেওয়া হলেও জনতাদের মধ্যে অনেকেরই সেটি অজানা! দিনের শুরু থেকে সবকিছুই চলছে সমানতালে।
বাম জোটের সমাবেশ ঘিরে সতর্ক অবস্থায় ছিল বিপুল সংখ্যক পুলিশ। আর হরতাল আহ্বানকারীদের পাশ দিয়েই চলছিল যানবাহন। হরতালে রাস্তাঘাট খালি থাকার পরিবর্তে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। নগরের প্রায় প্রতিটি সড়কে যানজট লেগে ছিল।
এদিকে, হরতালের সমর্থনে সিলেট নগরীর কোর্টপয়েন্টে অবস্থান নেয় বাম গণতান্ত্রিক জোট। সেখানে পুলিশি বেষ্টনীতে হাতে গোনা কয়েকজনের উপস্থিততে নেতাকর্মীরা বক্তৃতা দেন।
খুলনায় ৬ হরতাল সমর্থক আটক
খুলনায় বাম গণতান্ত্রিক জোটের ডাকা আধাবেলা হরতালের কোনো প্রভাব ছিল না। সকাল থেকে খুলনা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল সোনাডাঙ্গা থেকে দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। আন্তঃজেলার সব রুটে বাস চলাচল করেছে। অফিস, দোকান-পাট অন্যান্য দিনের মতো খোলা ছিল। হরতালে নগরজুড়ে সতর্ক অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
এদিকে সকাল ৮টার দিকে মহানগরীর গোলকমনি পার্কের সামনের সড়ক থেকে হরতাল সমর্থনে মিছিলের প্রস্তুতিকালে বাম জোটের ছয় নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটকরা হলেন—বাসদ জেলা আহ্বায়ক জনার্দন দত্ত নান্টু, সিপিবির মহানগর সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিত্যানন্দ ঢালী, সিপিবির নিরোজ রায়, মো. রাসেল ও কিংসুক এবং গণসংহতি আন্দোলন খুলনা জেলা আহ্বায়ক মুনীর চৌধুরী সোহেল।
বরিশালে জনজীবন ছিল স্বাভাবিক
হরতালে বরিশালে তেমন কোনো ধরনের প্রভাব পড়েনি। বরিশাল নগরে সব ধরনের থ্রি-হুইলার থেকে শুরু যাত্রীবাহী বাস ও লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক ছিল।
এদিন সকাল ৬টা থেকে নগরের কাকলীর মোড় এলাকায় বাসদের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয়। এ সময় তারা হরতালের পক্ষে স্লোগান দেন এবং নিত্যপণ্যের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনার দাবি জানান। বাসদের নেতাকর্মীরা হরতালের পক্ষে নগরে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। এছাড়া জোটের অন্যান্য দলগুলো নগরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হরতালের পক্ষে বিক্ষোভ করেন।
এদিকে সকাল থেকে বরিশাল নগরের নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এবং রূপাতলী বাস টার্মিনাল থেকে যাত্রীবাহী বাস চলাচল স্বাভাবিক ছিল। বরিশাল নৌ-বন্দর থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যায় ছোট ছোট লঞ্চ। নগরের অভ্যন্তরেও সব যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল।
রাজশাহীতে উত্তাপহীন হরতাল
হরতালে রাজশাহীর নগরজীবনে কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। সকাল থেকে বিভিন্ন সড়কে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক ছিল। মহানগরীর সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট, মণিচত্বর, সোনাদীঘির মোড়ে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের চাপ ছিল চোখে পড়ার মত। হরতালে কোনো পিকেটিংয়ের খবর পাওয়া যায়নি।
ভোর ৬টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত মহানগরীর গণকপাড়া এলাকায় অবস্থান নেন বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাকর্মীরা। তারা সেথানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এবং হরতালের সমর্থনে বিভিন্ন স্লোগান দেন। পরে হরতালের সমর্থনে সাহেববাজার জিরোপয়েন্টেও কিছুক্ষণ অবস্থান করেন তারা।
হরতালে ময়মনসিংহে সবই স্বাভাবিক
হরতালের প্রভাব ময়মনসিংহে খুব একটা চোখে পড়েনি। নগরীতে বাসসহ ছোট সব ধরনের যানবাহন চলতে দেখা গেছে। রাস্তা-ঘাটে মানুষের চলাচল ছিল অন্যান্য সব দিনের মতই স্বাভাবিক। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাটও খুলতে দেখা গেছে।
সকাল থেকে নগরীর বিভিন্ন স্থানে জোটের নেতা-কর্মীরা মিছিল, সমাবেশের চেষ্টা করলেও তেমন একটা সফল হতে পারেননি, পড়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার মুখে। হরতালে বিএনপি নৈতিকভাবে সমর্থন দিলেও দলটির নেতা-কর্মীদের কাউকে মাঠে দেখা যায়নি।
সিপিবির সভাপতি অ্যাডভোকেট এমদাদুল হক মিল্লাত বলেন, ‘আমাদের শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচিতে এসে র্যাব কয়েকজন নেতা-কর্মীকে আটকের চেষ্টা করে। আমরা গণগ্রেপ্তার দাবি জানালে তারা পিছু হটেন।’ তিনি জানান, কেন্দ্রীয় যেকোনো কর্মসূচি বাস্তবায়নে তারা প্রস্তুত রয়েছেন।
‘পুলিশি হামলার’ প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি মঙ্গলবার
হরতালে নেতাকর্মীদের ওপর ‘পুলিশি হামলার’ প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। সোমবার জোটের পক্ষ থেকে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করছিলাম। পুলিশ বিনা উসকানিতে আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করেছে। জলকামান ও টিয়ার শেল ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, পুলিশের হামলায় আমাদের বেশকিছু নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তাদের হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আজকের এ জঘন্য পুলিশি হামলার প্রতিবাদে মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) বিকেল ৪টায় বিক্ষোভ কর্মসূচি ডাকা হয়েছে।
আরএ/