দেশে ফিরে জাতির উদ্দেশে যা বললেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস
জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি: সংগৃহীত
শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফিরেছেন। রাত ৮টার দিকে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধান হিসেবে শপথ নেবেন। বৃহস্পতিবার (৮ আগস্ট) দুপুর ২টা ১০ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান তিনি।
এসময় তিনি কথা বলেছেন উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে। সেখানে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। সংঘাত-সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা কাটিয়ে দেশকে সঠিক পথে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে ড. ইউনূসের কথায়। বিমানবন্দরে তার সঙ্গে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
শুরুতেই ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আজ আমাদের গৌরবের দিন। যে বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজকে নতুন বিজয় দিবস সৃষ্টি করলো সেটিকে সামনে রেখে এবং আরও মজবুত করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যারা এটি সম্ভব করেছে, যে তরুণ সমাজ; তাদের প্রতি আমি আমার সমস্ত প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তারা আজকে আমার পাশে আছে।
‘তারা এ দেশকে রক্ষা করেছে, এ দেশকে নতুনভাবে পুনর্জন্ম দিয়েছে। পুনর্জন্মে যে বাংলাদেশ পেলাম, সেই বাংলাদেশ যেন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলতে পারে, সেটিই আমাদের শপথ। সেই শপথ আমরা রক্ষা করতে চাই, এগিয়ে যেতে চাই।’
তিনি বলেন, আজকে আবু সাঈদের কথা মনে পড়ছে। যে আবু সাঈদের ছবি বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের মনে গেঁথে আছে। এটি কেউ ভুলতে পারবে না। কী অবিশ্বাস্য এক সাহসী যুবক। বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর থেকে কোনো যুবক-যুবতী আর হার মানেনি। কত গুলি মারতে পারো, মারো; আমরা আছি।
ড. ইউনূস বলেন, যার কারণে সারাদেশে এ আন্দোলন ছড়িয়ে গেছে এবং বাংলাদেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা অর্জন করলো, সেই স্বাধীনতা আমাদের রক্ষা করতে হবে। শুধু রক্ষা নয়, এ স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি ঘরে পৌঁছে দিতে হবে। তা না হলে এ স্বাধীনতার কোনো দাম নেই। এ স্বাধীনতা পৌঁছে দেওয়াই আমাদের শপথ।
মানুষ যেন জানতে পারে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্থ হলো- তার নিজের পরিবর্তন, ব্যক্তির পরিবর্তন, সুযোগের পরিবর্তন, তার ছেলে-মেয়ের ভাগ্যের পরিবর্তন’- এ প্রসঙ্গে যোগ করেন তিনি।
আজকের তরুণ সমাজকে বোঝানো যে, এ দেশটা তোমাদের হাতে। তোমরা এ দেশকে তোমাদের মনের মতো করে গড়তেও পারবে। কীভাবে একটি তরুণ সমাজ একটি দেশ গ্রহণ করতে পারে এবং তা পাল্টে ফেলতে পারে।
ছাত্র-তরুণদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তাদের আমি উপদেশ দেই, পুরোনোদের বাদ দাও। পুরোনো চিন্তা দিয়ে এ দেশের মানুষের মুক্তি হবে না। তোমাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, সৃজনশীলতা আছে, সেই সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে।
আমাদের দেশে যেটি হয়ে আসছে, সেটি হলো- সরকার বলে যে জিনিসটা আছে, কিন্তু মানুষের কোনো আস্থা নেই। মানুষ মনে করে সরকার হলো একটি দমন-পীড়নের যন্ত্র। যেখানে সুযোগ পায় তারা মানুষকে কষ্ট দেয়। ভয়ের একটা জিনিস যেটা সামাল দিয়ে চলতে হয়। এটা সরকার হতে পারে না। সরকারকে দেখে মানুষের বুক ফুলে উঠবে। বলবে- এটা আমার সরকার, এরা আমাকে রক্ষা করবে। কিন্তু সরকার তাদের জন্য দাঁড়ায় না কখনো।
সরকার মানুষকে রক্ষা করবে, মানুষের আস্থাভাজন হবে। কেউ কাউকে জোর করবে না। মানুষ নিজে নিজে বিশ্বাস করবে যে, সরকারি লোক মানে আমার লোক, আমাকে রক্ষা করবে। সেই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তাহলে মানুষও যোগ দেবে। সারা বাংলাদেশ একটা পরিবার। সেই পরিবারে আমরা একসঙ্গে চলতে পারি। আমাদের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সরিয়ে ফেলতে হবে। যারা বিপথে গেছে, তাদের পথে ফিরিয়ে আনতে চাই।
ড. ইউনূস আরও বলেন, আমি দেশে আসার পথে জানতে পারলাম এখানে আইনশৃঙ্খলা ব্যাঘাত ঘটছে। মানুষ মানুষকে আক্রমণ করছে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সম্পদ নষ্ট করছে। অফিস-আদালতে হামলা হচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হচ্ছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, আহমদিয়া সবার ওপর আক্রমণ করছে। এগুলো হলো ষড়যন্ত্রের অংশ। আমাদের কাজ হলো তাদের রক্ষা করা।
প্রতিটি মানুষ আমাদের ভাই, আমাদের বোন। তাদের রক্ষা করাটা আমাদের কাজ। দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশৃঙ্খলা হলো অগ্রগতির বড় শত্রু’- বলেন তিনি।
আমাদের যে যাত্রা শুরু হলো, সেই যাত্রার পথে যে শত্রু তাদের বোঝাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দিতে হবে। কাউকে মেরে-কেটে শান্তি ফেরানো যাবে না। আইনশৃঙ্খলা নিজেদের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমন হতে হবে যে তাদের হাতে অপরাধীদের সোপর্দ করলে নিশ্চিত হতে পারবো যে এটার একটি আইনি বিহিত হবে। এমন নয় যে আমরা তাদের হাতে তুলে দিলাম, তারা দুইটা টাকা-পয়সা নিয়ে ছেড়ে দিলো। এটা যেন আবার না হয়।